বুধবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২৫ | ১৬ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ০৬:৫৩ ২৯ এপ্রিল ২০২৫
ঢাকাই চলচ্চিত্র অঙ্গনে ফের নতুন আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। এবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ১৭ জন নামি-দামি অভিনয়শিল্পী। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—গুরুতর অপরাধ ‘হত্যাচেষ্টা’র সঙ্গে সম্পৃক্ততা। মামলায় নাম উঠে এসেছে নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, জায়েদ খান, মেহের আফরোজ শাওন, সুবর্ণা মোস্তফা, রোকেয়া প্রাচী, নিপুণ আক্তার, সোহানা সাবা, আশনা হাবিব ভাবনা, জ্যোতিকা জ্যোতিসহ আরও বেশ কয়েকজনের।
ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহুরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন, ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ঢাকার ভাটারা থানাধীন এলাকায় সংঘটিত একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় এই অভিনয়শিল্পীদের আসামি করা হয়েছে। মামলাটি দায়ের করেছেন এনামুল হক নামের একজন নাগরিক। তিনি অভিযোগ করেছেন, এই তারকারা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
মামলার নথিপত্র অনুসারে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট ২৮৩ জন এবং আরও তিন-চারশ’ অজ্ঞাত ব্যক্তিকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে। নুসরাত ফারিয়াকে আওয়ামী লীগের অর্থ সহায়তাকারী হিসেবে উল্লেখ করে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগে। এ ছাড়া মামলায় অপু বিশ্বাস, সুবর্ণা মোস্তফা, রোকেয়া প্রাচী, ভাবনা, শাওন, জ্যোতিকা জ্যোতি, সোহানা সাবা, সাইমন সাদিক, জায়েদ খান, আজিজুল হাকিমসহ মোট ১৭ জন তারকার নাম রয়েছে।
ভাটারা থানা নিশ্চিত করেছে, মামলাটি তদন্তের জন্য তাদের কাছে এসেছে এবং আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তদন্ত কার্যক্রম চলছে। তবে চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি অঙ্গনে এই ঘটনা চরম আলোড়ন তুলেছে। এত সংখ্যক জনপ্রিয় তারকার বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যাচেষ্টার মতো মামলায় নাম আসা চলচ্চিত্র ইতিহাসে নজিরবিহীন।
বিভিন্ন পর্যায়ের বিশ্লেষক ও শিল্পী সমাজ এই মামলাকে শুধু আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখছেন না, বরং এতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিহিত আছে বলেও মনে করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব কবির বলেন, “এই মামলায় আদালতের ভূমিকা অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়া উচিত। যদি এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়, তবে তা আইনের অপব্যবহার। আবার অভিযোগ সত্য হলে, তা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দায়বদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে।”
অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমরা যদি সত্যিই হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকতাম, তাহলে এতদিনে প্রমাণ আসত। এই মামলা প্রমাণ করে, দেশে ভিন্নমত প্রকাশ করাও এখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।”
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই এই মামলাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানি হিসেবে দেখছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীণ অভিনেতা বলেন, “তারকারা রাজনীতি করতে পারেন, মত প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে এমন মারাত্মক অভিযোগ সাংস্কৃতিক পরিসরের স্বাধীনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।”
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি অঙ্গন বহুদিন ধরেই রাজনীতির ছায়ায় রয়েছে। তবে সরাসরি সহিংসতায় অংশগ্রহণের অভিযোগ, বিশেষ করে হত্যাচেষ্টার মতো অপরাধে এত সংখ্যক শিল্পীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়া নজিরবিহীন। এর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক জগতের নিরপেক্ষতা, মত প্রকাশের অধিকার এবং রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক শুরু হয়েছে।
এই মামলার তদন্ত ও বিচারিক কার্যক্রম যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জনমত ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের প্রতিক্রিয়া এটিকে কোন দিকে নিয়ে যায়, তা এখন দেখার বিষয়। এটি শুধু একটি মামলার প্রশ্ন নয়; বরং দেশের সংস্কৃতি ও রাজনীতির মধ্যকার সম্পর্ক, দায়বদ্ধতা ও স্বাধীনতা নিয়ে বৃহৎ এক প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করেছে।
বিজ্ঞাপন