সংবিধান নিয়ে আইন শিক্ষার্থীদের ভাবনা

সংবিধান নিয়ে আইন শিক্ষার্থীদের ভাবনা

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। আওয়ামী সরকার পতনের অন্যতম কারণ তাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের পাহাড়সম ক্ষোভ। মনে করা হয় স্বৈরশাসনের মূল হাতিয়ার ছিল সংবিধান। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট ছাত্র-জনতার বহুল প্রতীক্ষিত দাবি সংবিধানের সংস্কার কিংবা পুন:লিখন। সংবিধান নিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থীরা কি ভাবছে তা তুলে ধরছেন MoreNews ক্যাম্পাস প্রতিনিধি তানিম তানভীর।


সংবিধান নিয়ে কথা বললে প্রথমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের কথা মাথায় আসে। ৭ অনুচ্ছেদের সংবিধানটিতে দীর্ঘ ২৩৭ বছরে মাত্র ২৭টি সংশোধনী আনার প্রয়োজন পড়েছে। সংক্ষিপ্ত ও স্থিতিশীল সংবিধানটি মার্কিনীদের নাগরিক বা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্বতন্ত্র ভূমিকা রেখে যাচ্ছে সবসময়। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যদি বলি, প্রথমেই বলতে হবে- পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের পাশাপাশি নাগরিকদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলোর স্বীকৃতি ও তা বাস্তবায়নের রূপরেখা সংবিধানের মাধ্যমে হতে হবে। পাশাপাশি তা সংশোধনের উপায়ও থাকতে হবে, যাতে সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান বা এর কোন অংশে সংশোধন আনা যায়। বর্তমানের "নতুন সংবিধান নাকি সংবিধানের সংস্কার"- এই ভাবনা থেকে যদি বলি তাহলে প্রথমেই পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পর্কে বলতে হবে। পঞ্চদশ সংশোধনীর ফলে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই সংশোধন অযোগ্য হয়ে পড়েছে এবং এর অস্তিত্ব থাকাকালে সংবিধানের সেসকল অংশে হাত দিতে গেলে সেটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল হবে। সেক্ষেত্রে গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দিকে নজর দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, জনপ্রতিনিধি এবং বিচার বিভাগের প্রতিনিধিদের সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। পরিশেষে, আমি একটি বিচার-বিবেচনাপূর্ণ ও জনকল্যাণমুখী সংবিধানের কথা বলবো, যা মানবাধিকারের সুরক্ষা, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, সাংবিধানিক ভারসাম্য, পরিবর্তনশীলতা ও প্রাসঙ্গিকতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্র গঠনের পথ দেখাবে।

মেজবাউল আলম
আইন বিভাগ

 

সংবিধান একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জনগণের জীবনাচার, আশা আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় চরিত্রের সমষ্টি। ১৯৭২ সালের সংবিধানকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিজের মত করে ১৭বার সংশোধন করেছে। এতে বিগত আওয়ামী সরকার কিভাবে স্বৈরাচার হয়ে উঠেছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধের আত্নত্যাগে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম সে স্বাধীনতার সাধ এখনও পাইনি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করছি।
৭২এর সংবিধান ১৭বার সংশোধনের মাধ্যমে
তার মৌলিকত্ব হারিয়েছে। তাই এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য সংবিধানের পুনঃলিখন এখন সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবি। বাঙালি জাতির ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের বৈষম্যবিলোপ তথা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায় বিচার হবে প্রস্তাবিত সংবিধানের মূল ভিত্তি। সংবিধান পুন:লেখনের মাধ্যমে আমরা এমন একটি সংবিধান চাই যে সংবিধান কোন শাসককে স্বৈরশাসক হতে দেবে না। সংবিধানের মূল লক্ষ্য হবে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা। যেখানে সংবিধান দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার বিধান ও সুশাসন  নিশ্চয়তা দিবে। যে সংবিধান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মৌলিক এবং মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে  ঘুষ ও দুর্নীতি, জাতীয় সম্পদ পাচার, সন্ত্রাস -চাঁদাবাদি ও মাদকের অভিশাপ থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা দেবে।

মিশুক শাহরিয়ার
আল ফিকহ অ্যান্ড লিগাল স্টাডিজ

 

দেশের এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে কোন গ্রান্ড নর্ম (Grand norm) অনুসারে? ৭২এর সংবিধানের আলোকে নাকি বিপ্লব পরবর্তী একশনের মাধ্যমে?  এটা একটা দোদুল্যমান অবস্থার জন্ম দিয়েছে।
যেমন, রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুসারে তার কার্য পরিচালনা করছেন আবার সংবিধান খসড়া প্রণয়ন কমিটি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল উপায়ে পরিচালিত হচ্ছে।

রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন ও সংবিধানকে প্রকৃতরুপে জনগণের পরম আকাঙ্খার প্রতিফলন হিসেবে প্রতিষ্ঠাকরণে বর্তমান সংবিধান পুনঃলিখনের চেয়ে সংস্কারই যুক্তিযুক্ত এবং সময়োপযোগী। কারণ, বাংলাদেশের সংবিধানের কাঠামোগত প্রামাণিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কেননা, constitutional borowing এর মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সুপ্রতিষ্ঠিত ও গ্রহণযোগ্য সাংবিধানিক বিধানকে বর্তমান সংবিধানে স্থান দেওয়া হয়েছে, ঐসকল রাষ্ট্রে যার প্রয়োগের ফলে রাষ্ট্র কাঠামো জনগণের দায়, দায়িত্ব ও অধিকার এবং কর্তব্য সুসমভাবে নিশ্চিত হয়েছে। যা আমাদের রাষ্ট্রের জন্যও ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারে।
সংবিধান সংস্কারের মৌলিক উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার। তার প্রধান কাজগুলোর অন্যতম হচ্ছে বিগত সরকার কর্তৃক সংবিধানের বিভিন্ন বিধান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় অর্গানের পলিটিকাল এবিউজ করেছে। তাই এখন অন্য কেউ যাতে তা করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যাশিত সংবিধান যেন কাউকে দমনের হাতিয়ার না হয়। সেটা যাতে আমাদের অভিপ্রায়ের পরম ও প্রকৃত অভিব্যক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এটাই প্রত্যাশা।

মুস্তাফিজুর রহমান
আল ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ


“যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ”- প্রবাদটি বাংলাদেশের সংবিধানের সংশ্লিষ্টতার ক্ষেত্রে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের ৪ঠা নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক পাশকৃত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য ১/২টি বিধান ছাড়া(যেমন:অনুচ্ছেদ ৭০) সকল বিষয় নিয়ে একটি উন্নত সংবিধান আমাদের উপহার দেয়া হয়েছিল। সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার উপাদান নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু আফসোসের বিষয়- সংবিধান পাশের ক্ষণকাল যেতে না যেতেই জনগণের আকাঙ্খার বিপরীতে সংশোধনের মাধ্যমে জরুরী অবস্থা জারির বিধান, নিবারণমূলক আটক সংক্রান্ত আইন এবং মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন প্রনয়নের ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে সদ্য প্রজাতন্ত্রের ফিটাস সরুপ সংবিধানের গর্ভপাত করানো হয়েছিল। আরও বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে এমন ভাবে কাঁচিকাটা করা হয় যে, বর্তমানে উক্ত সংবিধান বিশ্বের নিকৃষ্ট সংবিধানে পরিণত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, এই সংবিধান এযাবৎকালে শুধুই রাবণ স্বরুপ শাসক এর জন্ম দিয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও জনগণ প্রজাতন্ত্রের প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হয়ে উঠেনি। তাই জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন এই বাংলাদেশে আমরা এমন এক সংবিধান (সংশোধনী, সংস্কার বা পুন:লিখন যেভাবেই হোক) চাই যেই সংবিধান এর মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার, ভোটের অধিকার এবং বাক-স্বাধীনতার অধিকারের স্বার্থ রক্ষা হয় এবং স্বৈরাচারী শাসক জন্মানোর পথ রুদ্ধ হয়।
মাহমুদুল হাসান জিহাদী
ল' অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট


বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। যেখানে সংবিধান বাঙালি জাতির রূপকার। সংবিধান দেশের সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির চালিকা শক্তি। জনগণের সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সংবিধান। তাই সংবিধানকে এমনভাবে প্রণয়ন বা সংশোধন করতে হবে যাতে দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয়তা এবং স্বতন্ত্রতা বজায় থাকে। সংবিধানে নাগরিকদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কিত বিষয়সহ মৌলিক ও মানবাধিকারগুলো থাকবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও স্পষ্ট বিধান থাকবে। সংবিধানে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা  বজায় রাখার স্পষ্ট নির্দেশনা এবং কেউ যাতে রাজনৈতিকভাবে সংবিধানকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সে বিষয়েও নির্দেশনা ও শাস্তির বিধান থাকতে হবে। সংবিধান হবে দেশের আইনকানুন ও প্রশাসনের ভিত্তি যা জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেবে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের মাধ্যমে জনগনের ভোট ও নির্বাচনের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। সকল প্রকার অবিচার ও বৈষম্য দূর করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র্যভাবে কাজ করবে। বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা শতভাগ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা এবং  ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, স্পিকার সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ পদের নিয়োগ, মেয়াদ, অপসারণ বিধিমালা, এখতিয়ার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সংবিধান একটি গতিশীল দলিল হবে। সমাজের পরিবর্তন, নতুন চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এটি সংশোধনযোগ্য হতে হবে।
তবে তা যেন জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয় এবং কোনো অপব্যবহার না হয় এবং ব্যক্তি কিংবা দলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তন অযোগ্য হবে। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে নতুনভাবে সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। 
মো: রাশেদ ইসলাম 
ল' অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট 
 

বিজ্ঞাপন