শীর্ষ আলেমদের জাতীয় পরামর্শ সভায় গৃহীত হলো ৭ প্রস্তাব

শীর্ষ আলেমদের জাতীয় পরামর্শ সভায় গৃহীত হলো ৭ প্রস্তাব

নিজস্ব প্রতিবেদক, মোরনিউজবিডি
নিজস্ব প্রতিবেদক, মোরনিউজবিডি

প্রকাশিত: ০৬:৩৬ ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দেশের চলমান পরিস্থিতিতে উলামায়ে কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের করণীয় শীর্ষক জাতীয় পরামর্শ সভায় গৃহীত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ৭ প্রস্তাব।

শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকাল দুপুর আড়াইটায় যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসায় (জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া) কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাক ও আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরামর্শ সভায় এসব প্রস্তাব গৃহীত হয়।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় প্রাসঙ্গিক বিষয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া মাদরাসায় দেশের শীর্ষ আলেম-ওলামাদের জাতীয় পরামর্শ সভা হয়েছে।

শনিবার গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদের খতিব ও কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান শায়খে যাত্রাবাড়ী আল্লামা মাহমুদুল হাসানের আহ্বানে ‘দেশের চলমান পরিস্থিতিতে উলামায়ে কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের করণীয়’ শীর্ষক এই জাতীয় পরামর্শ সভায় ওলামায়ে কেরামের করণীয় হিসেবে ৭ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

এতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা সাজিদুর রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (আইএবি) আমির মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম (পীর সাহেব চরমোনাই), আল্লামা মুফতী মিজানুর রহমান সাঈদ, ঢালকানগর পীর আল্লামা মুফতী জাফর আহমাদ, বাংলাদেশে কুরআন শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা নুরুল হুদা ফয়েজী, বেফাক মহাপরিচালক আল্লামা উবায়দুর রহমান খান নদভী, মাহসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, মুফতী মুস্তাকুন নবীসহ বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও দেশের শীর্ষ আলেম ওলামাগণ অংশ নেন।

সভায় সভাপতির বক্তব্যে কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাক ও আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসান দেশের সার্বিক কল্যাণ, ইসলাম, দেশ, মানবতা, ধর্মীয় তাহজিব-তামাদ্দুন রক্ষায় সর্বস্তরের ওলামায়ে কেরামকে পারস্পরিক মতবিরোধ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ২০২৪ সাল আমাদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বছর। গত জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের একটি পট পরিবর্তন ঘটেছে। যার মূলশক্তি ছিল সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। দেশবাসী এক হলে বড় কিছু করা যায়। এ সময়ে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার সাথে ওলামায়ে কেরামের ঐক্য ছিল লক্ষ্যণীয়। এ পর্যায়ে অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য সংহতিরও নজির সৃষ্টি হয়েছে। এক পর্যায়ে অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তারা রাষ্ট্রসহ মৌলিক অনেক পর্যায়ে সংস্কার সাধন করবেন বলে উদ্যোগী হয়েছেন। এ সংস্কার কাজে ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ এবং দেশ ও জাতির স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে কিনা, সেটা দেখা উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব।

আল্লামা মাহমুদুল হাসান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন গঠিত প্রতিটি কমিশনে শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব উলামায়ে কেরামের। বিশেষ করে সংবিধান সংস্কারে ইসলাম বিরোধী কোনো পদক্ষেপ যেন গ্রহণ করা না হয়, সেটা পর্যবেক্ষণ করা এবং সংবিধানসহ প্রতিটি কমিশনে উলামায়ে কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের অংশীদারিত্ব বহাল রাখা একটি কর্তব্য।

তিনি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান।

কওমি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের এমন মুহূর্তে শাসকরা ভুল করলে এই ভুলের মাশুল জাতিকে যুগ যুগ ধরে দিতে হবে। নতুন পরিস্থিতিতে জনগণের ঐক্য যেমন বিজয়ী হয়েছে, তাকে ধরে রাখার জন্যও ঐক্য প্রয়োজন। বিশেষ করে দুনিয়াবি জয়ের তুলনায় আমাদের নিকট দীনি বিজয়ের প্রচার প্রসার এবং প্রতিষ্ঠা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং দেশের পরিস্থিতি যাই হোক, ওলামায়ে কেরামের কাজ থেমে থাকবে না। পট পরিবর্তনে জাতি যে নতুন স্বপ্ন দেখছে, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যেমন জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই, তেমনি ইসলামী কার্যক্রমের সফলতার জন্যেও ওলামায়ে কেরামের ঐক্যের বিকল্প নেই।

দীনি বিষয়ে পারস্পরিক মিল মহব্বত বজায় রেখে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ধর্মপ্রাণ মানুষ এখন ওলামায়ে কেরামের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মের জন্য অপেক্ষমান। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন। ঐক্যবদ্ধ থেকে একটি গ্রহণযোগ্য শক্তি অর্জন করুন। তখন নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখেই ন্যায্য অধিকার আদায়ের টেবিলে শক্তি নিয়ে কথা বলতে পারবেন। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সে শক্তি আর থাকবে না। আপনারা এবার বিচ্ছিন্ন না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকলে স্থায়ীভাবে জনগণের মনে স্থান করে নেওয়া সম্ভব হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় নিঁখুত একটি শক্তি হিসেবে ইসলাম ও মুসলমানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।

শায়খে যাত্রাবাড়ী বলেন, আপনাদের মনে রাখতে হবে— সর্বাবস্থায় আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত, আকাবিরে দেওবন্দ ও বাংলাদেশের শত বছরের শীর্ষ মুরব্বি উলামায়ে কেরামের মত-পথ, নীতি ও আদর্শ সমুন্নত রাখতে হবে।

ইসমতে আম্বিয়া, আদালতে সাহাবা, আজমতে ফুকাহায়ে মুজতাহিদিন ও মুসলিহীনে উম্মত, শানে আয়িম্মায়ে আরবাআ, মাশায়েখে তরিকায়ে আরবাআ এবং খতমে নবুওয়তের সুমহান মর্যাদাসহ রদ্দে বাতিলের ঝাণ্ডাকে যেকোনো মূল্যে উড্ডীন রাখা চাই। নতুন বাংলাদেশ সংস্কারের সুযোগে ট্রান্সজেন্ডার, এলজিবিটিকিউ, সর্বধর্মবাদ, পাশ্চাত্য বেহায়াপনা, উগ্র নারীবাদ ইত্যাদির অন্তর্ভুক্তি যেন না হতে পারে, এ বিষয়েও উলামায়ে কেরামকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখতে হবে বলেও জোর দেন আল্লামা মাহমুদুল হাসান।

এছাড়াও তিনি আরও বলেন, মিশনারী অপতৎপরতা, বিদেশী এনজিওদের সন্ত্রাসী পদক্ষেপ বাংলাদেশের অখণ্ডতা বিরোধী যেকোনো কার্যক্রম ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আপনাদেরকে সজাগ থাকতে হবে।

সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ওলামায়ে কেরামের করণীয় শীর্ষক ৭টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেগুলো হলো—

এক. রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে সংবিধান সংস্কারে ইসলাম বিরোধী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না এবং সংবিধানসহ প্রতিটি কমিশনে উলামায়ে কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

দুই. শিক্ষা সংস্কার কমিটিতে ইসলামী শিক্ষাবিদ, কারিকুলাম ও সিলেবাস বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

তিন. সংস্কারের সুযোগে পাশ্চাত্য বিভিন্ন মতবাদ, ট্রান্সজেন্ডার, এলজিবিটিকিউ, উগ্র নারীবাদ, সর্বধর্মবাদ ইত্যাদি অনুপ্রবিষ্ট করা যাবে না।

চার. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শান ও মান এবং খতমে নবুওয়াত সমুন্নত রাখার জন্য আইন পাশ করতে হবে।

পাঁচ. রাষ্ট্র, সমাজ ও সরকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে শতকরা ৯২ ভাগ মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির মূল্যায়ন করতে হবে।

ছয়. বাংলাদেশের যাবতীয় দীনি কার্যক্রমের শরীয়াভিত্তিক বিশ্লেষণ ও দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য আল্লামা মাহমূদুল হাসানের নেতৃত্বে একটি কাউন্সিল গঠন করা হবে।

সাত. আজকের জাতীয় পরামর্শ সভা থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবাবলীর আলোকে ইসলামী অঙ্গনে ব্যাপক আকারে ঐক্যের রূপরেখা তৈরি করে আল-হাইয়াতুল উলিয়ায় উপস্থাপন করা হবে।

এদিন সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হওয়া জাতীয় এ পরামর্শ সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম, জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা মানুসুরুল হাসান রায়পুরী, ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী, মুফতি মোহাম্মদ আলী, মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, জমিয়ত মহাসচিব ড. মহিউদ্দিন ইকরাম, খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, মাওলানা সাদেক আহমদ সিদ্দিকী, মাওলানা আব্দুল আউয়াল (নারায়নগঞ্জ), মাওলানা মুসলেহুদ্দীন গওহরপুরী, মুফতী কেফায়াতুল্লাহ আযহারী, মাওলানা আবু জাফর কাসেমী, মাওলানা মুহিউল ইসলাম বুরহান, মাওলানা নুরুল ইসলাম (গাজীপুর), মাওলানা আলী আহমাদ (পীর সাহেব চণ্ডিবর্দি), মাওলানা শওকত হোসেন সরকার, মাওলানা মাসউদুল করীম, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযা, মাওলানা বোরহানুদ্দীন রাব্বানী, মাওলানা আনওয়ারুল হক, মুফতী মাওলানা গোলামুর রহমান, শহীদুল আনওয়ার সাদী, মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা রশীদ আহমদ, মাওলানা আবু তাহের নদভী, মুফতি সোহাইল প্রমুখ।

বিজ্ঞাপন