শনিবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২৫ | ১৩ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ০৫:১১ ২৪ এপ্রিল ২০২৫
দুই রাষ্ট্র—একই ভূখণ্ড থেকে জন্ম নেওয়া, কিন্তু দুই বিপরীত রাজনৈতিক দর্শনে পরিচালিত। ভারত ও পাকিস্তান, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের মাধ্যমে পৃথক হলেও তাদের সম্পর্কের ইতিহাস প্রায় পুরোটাই শত্রুতা, অবিশ্বাস ও সংঘাতপূর্ণ। অথচ এই দুই দেশের সংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাসে রয়েছে গভীর মিল। তাহলে কোথায় ভ্রান্তি? কেন বারবার এই উত্তেজনা?
অতীত ইতিহাস: দেশভাগ ও বৈরিতার শিকড়
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারত উপমহাদেশকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়। পাকিস্তান গঠিত হয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য আর ভারত বহুজাতিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশভাগের সময় প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন মানুষ স্থানান্তরিত হয় এবং communal দাঙ্গায় প্রাণ হারায় অন্তত ১০ লক্ষাধিক মানুষ।
কাশ্মীর তখন ছিল একটি রাজ্য, যার মহারাজা হরি সিং হিন্দু হলেও প্রজাদের অধিকাংশ ছিল মুসলিম। তিনি স্বাধীনতা চাইলেও পাকিস্তানের হামলার মুখে ভারতকে সাহায্যের জন্য ডাকে এবং একটি চুক্তির মাধ্যমে ভারত কাশ্মীরকে অন্তর্ভুক্ত করে। এ থেকেই শুরু হয় প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৪৭-৪৮)। তারপর থেকে কাশ্মীর ইস্যু হয়ে ওঠে দুই দেশের সব থেকে বড় বিরোধ।
বিভিন্ন যুদ্ধ ও সামরিক সংঘর্ষ
১. ১৯৪৭-৪৮ যুদ্ধ:
কাশ্মীর অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে প্রথম যুদ্ধ। যুদ্ধশেষে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি হয় এবং কাশ্মীরকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়—‘আজাদ কাশ্মীর’ (পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে) এবং ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ (ভারতের নিয়ন্ত্রণে)।
২. ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ:
আবারও কাশ্মীর ইস্যুতে সংঘর্ষ। উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যুদ্ধ শেষে তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায়।
৩. ১৯৭১ সালের যুদ্ধ:
পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) স্বাধীনতার সংগ্রামে ভারতের সরাসরি জড়িত হওয়া এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভারত মানবিক হস্তক্ষেপ করে। এর ফলেই সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। এই যুদ্ধ পাকিস্তানের জন্য ছিল এক বড় পরাজয় এবং চূড়ান্ত সামরিক বিপর্যয়।
৪. ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ:
কারগিল অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনারা (ছদ্মবেশে) অবস্থান নিলে ভারত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই যুদ্ধও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে।
সন্ত্রাসবাদ ও অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষ
মুম্বাই হামলা (২০০৮):
পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা মুম্বাইয়ে ধারাবাহিক হামলা চালায়, যাতে ১৬৬ জন নিহত হয়। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে সমর্থন আদায় করে।
পুলওয়ামা হামলা (২০১৯):
কাশ্মীরে আত্মঘাতী হামলায় ভারতের ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান নিহত হন। জবাবে ভারত বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তান পাল্টা জবাব দিলে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়। বিশ্ব-রাজনীতির চাপে উভয় পক্ষই যুদ্ধ এড়িয়ে যায়।
কূটনীতি ও রাজনৈতিক মনোভাব
ভারত-পাকিস্তান কূটনীতিতে একধরনের ‘স্টপ-গো’ নীতি বিদ্যমান। কখনও শান্তি আলোচনা, কখনও সীমান্তে গুলিবিনিময়। বিভিন্ন সরকার ও শাসকগোষ্ঠী কূটনৈতিক পরিস্থিতিকে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ:
আটল বিহারী বাজপেয়ী ও নওয়াজ শরীফ শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করলেও কারগিল যুদ্ধ তা ভণ্ডুল করে।
মনমোহন সিং ও গিলানি সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন কিন্তু মুম্বাই হামলার কারণে সব পেছনে যায়।
মোদি ও ইমরান খান আমলে কিছু নাটকীয় মূহূর্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত সম্পর্কের উন্নতি হয়নি।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
দুই দেশের এই স্থায়ী বৈরিতা শুধু সামরিক ব্যয়ের দিকেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর প্রভাব অর্থনীতি, শিক্ষা, মানবিক উন্নয়ন ও আঞ্চলিক বাণিজ্যেও পড়েছে।
দুই দেশের মিলিত সামরিক বাজেট: বছরে প্রায় $৭০-৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা উন্নয়নে ব্যয় করা গেলে বহু পরিবর্তন সম্ভব হতো।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে কম আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য এই দুই দেশের মধ্যেই, যা দুজনের জন্যই অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ।
মানবিক দৃষ্টিকোণ: জনগণের ইচ্ছা কী বলে?
জনগণের একটি বড় অংশ চায় শান্তি। বহু মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শান্তির পক্ষে কথা বলে, ক্রিকেট ম্যাচে একে অপরকে সমর্থন করে, এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়কে স্বাগত জানায়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতি ও মিডিয়া মাঝে মাঝে যুদ্ধোন্মাদনা উস্কে দেয়।
আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি ও বড় শক্তিগুলোর ভূমিকা
চীন: পাকিস্তানের প্রধান মিত্র, তবে ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে।
যুক্তরাষ্ট্র: ভারতের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব বাড়ালেও পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা প্রদান করেছে বহু বছর।
রাশিয়া: ঐতিহাসিকভাবে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
আরব বিশ্ব: পাকিস্তানের মুসলিম পরিচিতি থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তারা ভারতের দিকে ঝুঁকেছে।
ভবিষ্যতের পথে: সংঘর্ষ, স্থবিরতা না শান্তি?
বিশ্লেষকরা বলেন, দুই দেশের পারমাণবিক শক্তি যুদ্ধকে প্রতিরোধ করতে পারে, তবে সীমান্ত সংঘর্ষ, সাইবার হামলা ও 'প্রক্সি ওয়ার' এর সম্ভাবনা বাড়ছে। ভবিষ্যতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে চাই:
দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা
জনগণের চাপে শান্তির পক্ষে নীতি
আন্তর্জাতিক মহলের সক্রিয় ভূমিকা
নিরপেক্ষ মিডিয়া ও শিক্ষিত জনমত
উপসংহার
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক একটি ‘বিস্ফোরণ-প্রবণ ভারসাম্য’-এর উপর দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাস রক্তাক্ত হলেও ভবিষ্যৎ একমাত্র আলোচিত হতে পারে শান্তি ও পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে। এখন প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব ও জনমত, যারা সংঘাত নয়, সমঝোতার গল্প লিখবে।
বিজ্ঞাপন