শনিবার , ২৬ জুলাই, ২০২৫ | ১১ শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০:২৭ ২৫ জুলাই ২০২৫
গত মাসে ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের সংঘর্ষকে ‘সফল’ দাবি করে এবার নতুন করে আরেকটি হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল—এমনটাই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক বক্তব্য ও কৌশলগত পদক্ষেপগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, তারা ইরানে আরও এক দফা ধ্বংসাত্মক হামলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। যদিও অস্ত্রবিরতি এখনো কার্যকর, তবে পরিস্থিতি যে আবারও যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, সে বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইরান ও পশ্চিমা বিশ্লেষকরা। কূটনৈতিক সমঝোতা ব্যর্থ হলে মধ্যপ্রাচ্য নতুন এক অস্থিরতা ও সংঘাতের মুখোমুখি হতে পারে।
গত জুনে ইসরায়েলের আকস্মিক হামলা থেকেই শুরু হয়েছিল প্রথম দফার যুদ্ধ, যাতে নিহত হয় এক হাজারের বেশি ইরানি এবং ২৯ জন ইসরায়েলি নাগরিক। ইসরায়েলের দাবি, তারা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করতে আত্মরক্ষার অংশ হিসেবে আগেভাগেই পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে ইরান বরাবরই বলে আসছে, তাদের পরমাণু কার্যক্রম শান্তিপূর্ণ বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ-পরবর্তী বক্তব্যে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, প্রয়োজনে তারা আবারও হামলা চালাতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, “আমি গ্যাসের প্যাডাল চাপা বন্ধ করার কোনো চিন্তাই করছি না।” নেতানিয়াহুর এমন মনোভাব ইঙ্গিত দেয়, সংঘাতের দ্বিতীয় অধ্যায় খুব বেশি দূরে নয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল কেবল ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোকেই লক্ষ্যবস্তু করেনি। বরং দেশটির উচ্চপর্যায়ের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও টার্গেট করেছে। এতে বোঝা যায়, তেলআবিবের লক্ষ্য শুধু ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নয়, বরং দেশটির শাসনব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলা।
মার্কিন থিংকট্যাংক কুইন্সি ইনস্টিটিউটের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ইরানবিষয়ক বিশ্লেষক ত্রিতা পার্সি বলেন, “ইসরায়েল চায় ইরানকে সিরিয়া বা লেবাননের মতো একটি দেশে পরিণত করতে—যাকে যখন খুশি আঘাত হানা যায়, আর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া খুব একটা আসে না।”
ইসরায়েল যদি আবার যুদ্ধ শুরু করতে চায়, তবে তাদের দরকার যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি—এটা অনেক বিশ্লেষকেরই অভিমত। এ নিয়ে ইতোমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আগস্টের মধ্যে ইরানের সঙ্গে নতুন কোনো পরমাণু চুক্তি না হলে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাগুলো আবার কার্যকর হবে।
২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে সই হওয়া চুক্তির ফলে এসব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে আবারও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এখন যদি ইউরোপীয় দেশগুলোও সেই পথে হাঁটে, তাহলে ইরান হয়তো পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি থেকেও বেরিয়ে যেতে পারে। এতে ইসরায়েলের পক্ষে হামলার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা সহজ হয়ে যাবে।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলছে, ইসরায়েল এর মধ্যেই ইরানে গোপন অভিযান শুরু করেছে। স্থানীয় এজেন্ট ও ড্রোনের মাধ্যমে চালানো এসব অভিযানে বিস্ফোরণ ঘটছে তেল শোধনাগার, ফ্ল্যাট, বিমানবন্দর ও কারখানায়। তিনজন পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও একজন ইউরোপীয় কূটনীতিকের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব বিস্ফোরণের পেছনে ইসরায়েলের গোপন নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে।
ইরানও এসব অভিযানের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে। সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্ট গুপ্তচরবৃত্তির জন্য মৃত্যুদণ্ড ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিধান পাশ করেছে। ইরানবিষয়ক বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, “ইসরায়েল ইরানে একটি সুসংগঠিত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যা প্রয়োজনে কিছু না কিছু ঘটিয়ে বার্তা দিতে চায়।”
অন্যদিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ইসরায়েল আবার কোনো হামলা চালালে আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমাদের সেনাবাহিনী ইসরায়েলের গভীরে আঘাত হানতে সক্ষম।”
বিশ্লেষক নেগার মরতাজাভির মতে, “ইরান জানে যে একটি কূটনৈতিক চুক্তি হলে ইসরায়েল হামলার সুযোগ হারাবে। তাই তারা চাইছে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান। কিন্তু একই সঙ্গে তারা জানে, দ্বিতীয়বার আর প্রস্তুতিহীন থাকা চলবে না।”
ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে। নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ, বিশেষ করে গাজায় সামরিক অভিযানের কারণে। তবে ইরান ইস্যুতে দেশজুড়ে জাতীয় ঐকমত্য রয়েছে। ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, “নেতানিয়াহু যদি মনে করেন, তার রাজনৈতিক অবস্থান ঝুঁকিতে, তাহলে ইরানকে আঘাত করে জনগণকে নিজের পাশে আনতেই পারেন।”
সবমিলিয়ে পরিস্থিতি আপাতত থমথমে হলেও, যুদ্ধের আগুন আবারও জ্বলতে শুরু করতে পারে যে কোনো সময়। মধ্যপ্রাচ্য হয়তো দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।
বিজ্ঞাপন