রবিবার , ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১১ ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ছবি: সংগৃহীত
প্রকাশিত: ০৪:৪১ ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
সংবিধানের ১৫২(২) বিলোপের প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন
২০১১ সালে আওয়ামী লীগের করা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত হওয়া ১৫২(২) অনুচ্ছেদ বিলোপের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে পঞ্চম তপশিলে ৭ মার্চের ভাষণ, ষষ্ঠ তপশিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সপ্তম তপশিলে মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের অংশ করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে সংযোজিত এ তিনটি তপশিল সংবিধানে না রাখার প্রস্তাব করেছে কমিশন।
গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয় অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন। গত ১৫ জানুয়ারি এই প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়া হয়।
সংস্কার কমিশন সংবিধানের ১৫৩টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ৬৪টি সংশোধন ও পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে। সংবিধানের প্রস্তাবনাও সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে, যেখানে ১৯৭১ সালের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে প্রস্তাবনার অংশ করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন চারটি অনুচ্ছেদ সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে সংবিধানের সংস্কারের পদ্ধতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। প্রচলিত বিধান অনুযায়ী, সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা যায় না। শেখ হাসিনা সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের বড় অংশকে মৌলিক কাঠামো হিসেবে সংরক্ষণযোগ্য করেছিলেন। তবে আদালত পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে দেওয়া এক রায়ে এই অংশকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। ফলে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব, তবে তা আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে সম্ভব নয়।
সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ ‘ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী’ সংক্রান্ত। এতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ দেশ স্বাধীন হওয়ার দিন থেকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, রাষ্ট্রপতির আদেশ, এবং অন্যান্য বিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ১৫০(২) অনুচ্ছেদ যোগ করেছিল, যা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল বিলোপের দাবি জানিয়েছে। বিএনপি এই সংশোধনীকে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রান্তিকালকে অস্বীকার করার সামিল বলে মনে করে।
বিএনপির অবস্থান অনুযায়ী, দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক। তবে আওয়ামী লীগ তা নাকচ করে এবং যুক্তি দেয় যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ থেকে প্রকাশিত সংবাদকে এই দাবির সমর্থনে দলিল হিসেবে তুলে ধরে।
তবে মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকারসহ অনেকে এই দাবি নাকচ করেছেন। তাদের মতে, এমন কোনো ঘোষণার কথা তারা একাত্তরে জানতেন না এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জীবদ্দশাতেও এমন তথ্য সামনে আসেনি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবার এই দাবিকে সামনে আনা হয়। তবে হাইকোর্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সম্পর্কেও সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে। বাহাত্তরের সংবিধানে এই ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসনের সময় এটি রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা সরকার আবারও এই ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেয়, তবে উচ্চ আদালত ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছে। সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে যে, রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ প্রক্রিয়ায় নতুন নিয়ম চালু করা হোক।
সংবিধানের সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ জানিয়েছেন, এটি নির্ধারণ করবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো। কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন গণভোট, রাজনৈতিক ঐকমত্য অথবা পরবর্তী সংসদের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হতে পারে বলে মত দেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপন