বাঙালি পোশাকেও রবীন্দ্র প্রভাব

বাঙালি পোশাকেও রবীন্দ্র প্রভাব

ছবি সংগৃহীত

উজ্জ্বল রায়
উজ্জ্বল রায়

প্রকাশিত: ০৯:০৩ ৬ আগস্ট ২০২৪

শান্তি নিকেতনে একটি মারাঠি ছেলের গল্প শুনিয়েছেন রসিকপ্রবর সৈয়দ মুজতবা আলী -- ' দেহলী থেকে বেরিয়ে শালবীথি হয়ে গুরুদেব চলেছেন লাইব্রেরির দিকে,পরণে লম্বা জোব্বা, মাথায় কালো টুপি।ভান্ডারে দেখামাএই ছুটলো তাঁর দিকে...।  আড়াল থেকে সবাই দেখলে ভান্ডারে  গুরুদেবকে কী যেন একটা বললে,গুরু দেব মৃদুহাস্য করলেন, মনে হল যেন অল্প অল্প আপওি  জানাচ্ছেন।ভান্ডারে চাপ দিচ্ছে।শেষটা গুরুদেবের হাতে কী যেন গুঁজে দিলো।গুরুদেব আবার মৃদুহাস্য ক'রে জোব্বার নীচে হাত চালিয়ে ভিতরের জেবে সেটি রেখে দিলেন।'

মারাঠি বালকের পদবি ভান্ডারে, সদ্য এসেছে শান্তি নিকেতনে পড়তে।বেচারা তখনও চিনত আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথকে।সে জানত, পথে ফকির -দরবেশ দেখলে কিছু দান করতে হয়।মায়ের পরামর্শ এটি।তাই একটি " আঠান্নি" সে দান করেছে 
'ফকির' রবীন্দ্রনাথকে!
মাঝে মধ্যে বিড়ম্বনায় পড়লেও এই আলখাল্লা বা জোব্বা অনেক দিক থেকে সাহায্য করেছে রবীন্দ্রনাথকে।সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছে "গুরুদেব" বা "ঋষি " হয়ে উঠতে,আর ঠাকুরপূজোর মূর্তি হয়ে উঠতে।অথচ এমন নয় যে,চিরকাল এটাই ছিলো তাঁর পোষাক ; এ বাদশাহী আলখাল্লা এসেছে জীবনের শেষ পর্বে।তার আগে নানা সময়ে নানা পোশাকে দেখা গিয়েছে তাঁকে।অন্নদাশঙ্কর লুঙ্গি পরতেও দেখেছেন।১২-১৩ বছর বয়স থেকে আশি বছর বয়স পর্যন্ত তোলা রবীন্দ্রনাথের আলোকচিত্রগুলির দিকে দৃষ্টি দিলে পোশাকের পরিবর্তন স্পষ্ট চোখে পড়ে।পুএ রবীন্দ্রনাথের সাক্ষ্যে জানা যায়, সে তালিকায় ছিল পায়জামা, ধূতি,পান্জাবী, ট্রাউজার, গলাবন্ধ - কোট,আচকান,চোগা- চাপকান, পিরহান, পাগড়ি - টুপি - চাদর ইত্যাদি। কিন্ত পঁচিশে বৈশাখ চিরদিন রবীন্দ্রনাথকে দেখেছে ধূতি - পান্জাবী - উওরীয়তে। এমনকী, ইরানে,চিনদেশে, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে,প্রশান্ত মহাসাগরে ভেসে চলা জাপানি জাহাজে।
তবু ধূতি - পান্জাবীকে বাঙালি পুরুষের মান্য পোষাক বলে চিরকালের তো দাগিয়ে দেননি রবীন্দ্রনাথ। উর্ওীণ যৌবনে এসে পাঠান- মোগলের পোষাক ছেড়ে সাধারণ বাঙালির ধূতি - পান্জাবীকে বরণ করলেও মনে হয় এই সময় থেকেই বাঙালি পুরুষের জন্য একটা মান্য পোশাক নির্ধারণ করবার অলিখিত দায় নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।সম্ভবত তার একটি কারণ, ইতিমধ্যে তাঁরই মেজবউদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বাঙালি রমণীর শাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন রমণীয়তা ও শালীন আধুনিকতা। হয়তো আরও একটি কারণ, বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথের ব্যঙ্গ, ' বিনা কোটটা হ্যাটাটা ধূতি পিরহানে মান রয় না"।বাঙালি রমণীর শাড়ি,নান্দনিকতা ও আভিজাত্য এ পোশাক আমাদের চিরকালের গর্বের ধন; এবং তখনই মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে,তাহলে বাঙালি পুরুষের পোশাক কী? কিংবা আদৌ কোনও নিজস্ব পোশাক আছে কি? ধূতিটুকু মেনে নেওয়া যায়, কিন্ত পান্জাবি? সে তো বাঙালির নয়,শব্দটির মধ্যই রয়েছে উওর ভারতীয় ছোঁয়া, এসেছে আরও উওরের দেশ থেকে।
তখন দেওয়ালের দিকে মুখ তুললেই বোঝা যায়, পোশাক নিয়ে উনিশ শতকের বিশিষ্ট কয়েকজন বাঙালির দ্বিধার ভাবটি। প্রিন্স দ্বারকানাথ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধূসূদন, দেবেন্দ্রনাথ,শ্রীরামকৃষ্ণ, বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, দ্বিজেন্দ্রলাল --- এরা কেউই সাহেবি পোশাক, কেউ কেবল ধূতি - চাদর,কেউ পাগড়ি, কেউ বা কাবুলি - পাঠান পোশাক স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন।বিবেকানন্দ সন্ন্যাসীর বেশ অনেকটাই অনেকটাই ঐতিহ্যবাহী, কেবল উজ্জ্বল কমলা রং - টা আধুনিক। কিন্ত এঁরা তো কেউ রবীন্দ্রনাথ নন; সংস্কৃতি গড়ে তোলার অলিখিত দায় কাঁধে তুলে নেননি।কেবল আভিজাত্য আর সৌন্দর্যের চেয়ে পোশাকের মধ্য দিয়ে আর বেশি কিছু তাঁদের চাওয়া ছিল না।
সমস্যাটা খানিক ধরতে পেরেছিলেন বোধহয় একা বঙ্কিম চন্দ। তাই তাঁর সৃষ্ট হনুমান ( হনুমদ্বাবু সংবাদ) নিজ গৃহে জল খাওয়া, বন্ধু গৃহে মদ খাওয়া এবং বেশ্যাগৃহে গলাধাক্কা খাওয়া বাবু- বাঙালির কোট- পেন্টুলুন- টুপি - চশমা - চেন- চাবুক খুলিয়ে ছেড়েছিলে,কিন্ত বাঙালি পুরুষের সঠিক পোষাক নির্ণয় করে দিতে পারেনি। বিলাত থেকে রাজপুএের সঙ্গে আগত তাঁর বিশেষ কলমচি বাঙালির পোশাক সম্পর্কে লিখেছেন, ' কেহ কেহ আমাদিগের মতো পেন্টুলন পরে,কেহ কেহ তুর্কদিগের মতো পায়জামা পরে, এবং কেহ কেহ কাহার অনূকরণ করিবে,তাহার কিছুই স্হির করিতে না পারিয়া বস্ত্র গুলি কেবল কোমরে জাড়াইয়া রাখে।' 
বাঙালি পুরুষের পোশাকের দৈন্য প্রথম ধরা পড়েছিল দ্বারকানাথ - রামমোহনের মতো নবজাগ্রতদের কাছে।উনিশ শতকে সে পোশাকের এিমুখী বিবর্তন চোখে পড়ে।একটি কোট - প্যান্ট ইত্যাদি সাহেবি পোশাক,আরেকটি ধূতি- চাদরে মোড়া বাঙালির পোশাক, অন্যটি আফগানিস্তান -তুরস্ক থেকে আসা মুসলমানি পোশাক।আর এখন চলছে এ সবের মিলিজুলি সংস্করণ। কয়েক দশক আগেও ধূতির উপরে কোট পড়া বাঙালি দেখা যেত,  কিংবা মুসলমানি পায়জামার সঙ্গে ইউরোপীয় শার্ট।গেন্জি - বারমুডা এসেছে হালে।তবু পান্জাবীর সঙ্গে ধূতি বা পাজামা থাকলেই বাঙালি পুরুষের মোটামুটি মান্য পোশাক বলে ধরে নেয়া হয়।অথচ ধূতি - পান্জাবির এই সমন্নয়টি কিন্ত দো- আঁশলা।পাজামার তো কথায় নেই।পান্জাবি এসেছে উওর - পশ্চিমে ভারত থেকে বা আরও বেশি উওর- পশ্চিমে  ভারতসীমার   বাইরে ইরান- আফগানিস্তান থেকে।এটা জানতেন ঠাকুর পরিবারের আলোকপ্রাপ্ত পুরুষরা।তাই পাঠান - মোঘল পোশাকের সাথে খানিকটা ইউরোপীয় স্টাইল মিশিয়ে তার উপরে বাঙালির চাদর কাঁধে তুলে নিয়ে সমন্নয়বাদী হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।এমনকি রবীন্দ্রনাথও।কিন্ত তৃপ্তি আসেনি এবং একে চূড়ান্ত বলেও মানতে পারেননি।তাই পোশাক বদল করেছেন বারে বারে। কিন্ত, পঁচিশে বৈশাখে জন্মদিনের উৎসবে ধূতি - পান্জাবিতেই সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন।আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁর জন্মদিন প্রথম পালিত হয় ২৭ বছর বয়সে।অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্যি যে, ২৫ -২৬ বছর বয়স পর্যন্ত ঠাকুরবাড়ির এই কনিষ্ঠ  পুএটির জন্মদিন উদযাপনের কোন খবর পাওয়া যায় না। মা বা অতি প্রিয় দুই বউদি, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ও কাদম্বরী দেবী, কেউই বালক রবীন্দ্রনাথের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে পায়েশের বাটি এগিয়ে দিয়েছেন,এমন কোন খবর- ছবি নেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে।

বিজ্ঞাপন