বৃহস্পতিবার , ২১ নভেম্বর, ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন রাজশাহী শহরের স্বেচ্ছাসেবীরা
প্রকাশিত: ০১:১৫ ১০ আগস্ট ২০২৪
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই সারা দেশের মতো রাজশাহীতেও সরকারি স্থাপনাগুলোয় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে এবং রাতভর তা চলে। পরদিন সকালে রাজশাহী শহরকে একটা ধ্বংসস্তূপের মতো মনে হয়। রাজশাহী নগর ভবন, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তর, বিভিন্ন থানা ও সরকারি দপ্তরগুলো প্রায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত দেখতে পাই।
একই দিন ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় রাজশাহীর শহরের অন্যতম গর্ব বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের ওপরও দুষ্কৃতকারীদের নজর পড়ে। শুনলাম, কারা যেন জাদুঘরে হামলা করতে এসেছে। তখনই অনুভব করি, কিছু একটা করতে হবে। পাশেই ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন। তিনি বলেন, ‘চলেন জাদুঘরে। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, অনেক মানুষ ভিড় করে আছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। স্থানীয় কয়েকজন ছাত্র স্বেচ্ছায় সেই রাতে জাদুঘর পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন। পরে আমরা চলে আসি। সেখানে আমরা জানতে পেলাম জাদুঘরে হামলার সংবাদটা একটা গুজব ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা আমাদের মনে শঙ্কার জন্ম দিল।’
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংখ্যালঘু, সংগীতশিল্পী, বাউলদের ওপর হামলার খবর আসতে থাকলে আমরা উদ্বিগ্ন হই। নিউটন ভাই স্বেচ্ছাসেবীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি চিত্রপরিচালক মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামসহ আরও কয়েকজন উদ্যোগী যুবক ও ছাত্রদের বিষয়টি জানান। আমিও একই প্রয়োজন অনুভব করি। ৭ জুলাই দুপুরে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজশাহীর সবাইকে আহ্বান জানাই, এ বিষয়ে আলোচনায় বসার জন্য। বরেন্দ্র জাদুঘরের সামনে সন্ধ্যায় আলোচনা শেষে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে ‘সেভ রাজশাহী’ নামে একটি গ্রুপ খোলা হয়। সেখানে আমরা দায়িত্ব ভাগ করে নিই, কারা শহরের কোথায় কী দায়িত্ব পালন করবেন। শুরু হয় আরেক প্রতিরোধ।
গ্রুপ খোলার পরপরই রাত ১০টায় খবর পাই সিঅ্যান্ডবি মোড়ে কিছু দুষ্কৃতকারী জড়ো হয়েছে। তারা সেখানে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালটি ভেঙে ফেলবে। ম্যুরালটি দেশের বৃহত্তম। এলাকাটি আমার পরিচিত হওয়ায় আমি একাই সেখানে যাই। এলাকাবাসীদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি এবং তাদের নিবৃত্ত করতে সক্ষম হই।
আমাদের গ্রুপের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। তিনি সবাইকে রাস্তায় শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব দেন। এরাই পালাক্রমে জাদুঘরসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো বিশেষ করে সিঅ্যান্ডবি মোড়, চিড়িয়াখানা, কোর্ট বাজার, নওদাপাড়া বাজার, ব্যাংক পাড়া, স্বর্ণকারপট্টি, সাহেববাজার, শহরের বাইরে নওহাটা, ও কাটাখালীতে অবস্থান নেন, যাতে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা এড়াতে তাঁরা সত্বর ভূমিকা রাখতে পারেন। উপাসনালয়গুলোয়ও ছাত্র–যুবকেরা পালাক্রমে রাত জেগে কাজ করছেন।
এক দিনেই গ্রুপে যোগদানকারী স্বেচ্ছাসেবী সদস্যসংখ্যা হাজার পেরিয়ে যায়। তাঁরা নগর ভবন, চিড়িয়াখানা, হাইটেক পার্ক ও থিম ওমর প্লাজা থেকে চুরি যাওয়া সামগ্রী উদ্ধারে নেমে পড়েন, উদ্ধার করতে সমর্থ হন বিপুল সামগ্রী। তাঁদের কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে। তাঁরা অব্যাহতভাবে চেষ্টা করছেন, সচেতন জনসমাজ সম্মিলিতভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে শহর ও শহরের মানুষদের সুরক্ষিত রাখতে।
গ্রুপের সদস্যরা সেনাবাহিনী, আনসার, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্ট, স্কাউট, বিএনসিসি এবং সাংবাদিকসহ আরও যেই সব সংস্থা কাজ করছে, তাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রয়োজনে এগিয়ে যাচ্ছেন।
স্বেচ্ছাসেবীরা সরকারি বিভিন্ন ভবনের চুরি যাওয়া সামগ্রী উদ্ধারে নামেন
স্বেচ্ছাসেবীদের প্রতিদিনের যাতায়াত, খাবার ও অন্যান্য খরচ বাবদ একটা ছোট ফান্ড গঠন করা হয়েছে, সদস্যদের মধ্য থেকেই যার জোগান দেওয়া হচ্ছে। আমাদের গ্রুপে কোনো নেতা নেই, সবাই কর্মী। আমাদের পরিকল্পনা আছে গ্রুপটাকে ওয়ার্ডভিত্তিক রূপ দেওয়া। আমাদের গ্রুপে ছাত্র ছাড়াও রিকশাচালক, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, উকিল, লেখক, ফটোগ্রাফারসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ আছেন। তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যাচ্ছেন।
এই গল্পটি বলার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাজশাহীতে ইতিমধ্যেই আমাদের গ্রুপটি সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে। উল্লেখ করার মতো হারানো সামগ্রী আমরা ফিরে পেয়েছি। তবে এখনো যেহেতু কর্মকাণ্ড চলমান আছে, তাই এখনই একটা সামগ্রিক হিসাব দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রাজশাহীতে আমাদের গ্রুপের মতো দেশের সব প্রান্তেই এক বা একাধিক গ্রুপ করে কাজ করা গেলে সব নাগরিকের নিরাপত্তাই নিশ্চিত করা যাবে। শেষ করার আগে আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে নিউটন ভাইয়ের অবদানের কথা স্বীকার করছি, তাঁর পরামর্শ এবং পরিকল্পনা আমাদের প্রতি মুহূর্তে চলার পথে সাহায্য করছে।
বিজ্ঞাপন