রবিবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৮ পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ০৯:৪০ ৯ ডিসেম্বর ২০২৪
সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের সরকার পতনের পরই খুলে দেয়া হয়েছে কুখ্যাত কারাগার সেদনায়ার ফটক। ছাড়া পেয়েছেন বছরের পর বছর ধরে বন্দী হয়ে থাকা কয়েদিরা। কেমন ছিল ওই সেদনায়া কারাগার? কী চলতো ওই বধ্যভূমির চার দেয়ালের আড়ালে? ফিরে দেখা যাক ইতিহাস।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১১ সাল থেকে একের পর এক গুম, খুন ও অমানবিক নির্যাতন চলেছে সিরিয়ার এই কারাগারে। ইংল্যান্ডের সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইট্স-এর ২০২১ সালের একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, সিরিয়ার জেলগুলোতে এক লাখেরও বেশি বন্দির মৃত্যুদণ্ড কিংবা জেলহেফাজতে মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ৩০ হাজারেরও বেশি বন্দি সৈদনায়ার!
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন থেকেই জানা যায়, সৈদনায়ার চৌহদ্দির মধ্যে রয়েছে দু’টি পৃথক জেল। একটি লাল ও একটি সাদা রঙের ভবন। লাল রঙের ভবনে রাখা হতো সাধারণ নাগরিকদের। আর সাদা রঙের ভবনে থাকতেন সামরিক ও রাজনৈতিক বন্দীরা। আল-কাবুনের মিলিটারি ফিল্ড কোর্টে নামমাত্র বিচারের পর ফাঁসির সাজা শোনানো হতো লাল ভবনের বন্দীদের। ‘বিচারপ্রক্রিয়া’ শেষ হয়ে যেত মাত্র এক থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই। যে দিন এক একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতো, ওই দিনটিকে ‘পার্টি’ বলে অভিহিত করতেন কারারক্ষীরা। কখনো কখনো আবার গণফাঁসিরও আয়োজন করা হতো। তালিকায় নাম থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের এক এক করে নিয়ে আসা হতো লাল ভবনের বেসমেন্টের একটি গোপন কক্ষে। সেখানে দুই তিন ঘণ্টা ধরে চলতো অকথ্য অত্যাচার ও মারধর। তারপর গভীর রাতে চোখ বেঁধে বন্দিদের নিয়ে যাওয়া হতো সাদা ভবনের একটি নির্দিষ্ট কক্ষে। সেখানেই একসাথে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হতো তাদের।
প্রতি সপ্তাহে এক কিংবা দু’বার এই ‘পার্টি’ হতো। প্রতি ‘পার্টি’র রাতে ফাঁসি হতো ২০ থেকে ৫০ জন কয়েদির। তবে এই ‘পার্টি’-র বিষয়ে ঘুর্ণাক্ষরেও জানতে পারতেন না বন্দিদের কেউ। ফাঁসির মাত্র মিনিটখানেক আগে তাদের জানানো হতো, মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তাদের! এমনকি লাল ভবনের কারারক্ষীরাও জানতে পারতেন না, গভীর রাতে সাদা ভবনে নিয়ে যাওয়ার পর বন্দিদের সাথে কী হয়। ফাঁসির পর লাশগুলো ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হতো তিশরিন হাসপাতালে। সেখানে নামপরিচয় নথিভুক্তকরণের পর গণকবর দেয়া হতো। অ্যামনেস্টির দাবি, ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার বন্দিকে বিনা বিচারে এভাবেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সৈদনায়ায়।
সৈদনায়ায় বন্দিদের উপর অত্যাচারের ইতিহাসও কম নয়। বন্দিদের নির্বিচারে মারধরের পাশাপাশি চলত যৌন নির্যাতনও। কখনো কখনো এক বন্দিকে দিয়ে আর এক বন্দিকে ধর্ষণ করানো হতো। এর পাশাপাশি পর্যাপ্ত খাবার, পানি ও ওষুধ কিছুই জুটতো না। অত্যাচারের সময় মুখ বেঁধে রাখা হতো বন্দিদের। অকথ্য অত্যাচারের ফলে কোনো কোনো বন্দি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেন। রোববারই সৈদনায়া থেকে মুক্তি পাওয়া এক বন্দির ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে (যদিও ওই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)। তাতে দেখা যাচ্ছে, সৈদনায়ার বাইরে রাস্তার ধারে গায়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে রয়েছেন শীর্ণ এক যুবক। কথাবার্তা অসংলগ্ন। অত্যাচারের চোটে ভুলেছেন নাম-ঠিকানাও। ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসার পরেই ফের এক দফা চর্চা শুরু হয়ে গেছে সিরিয়ার কুখ্যাত এই জেল নিয়ে।
সৈদনায়ার ফটক খুলতেই উচ্ছ্বাস শুরু হয়ে গেছে ওই দেশে। তবে সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইট্স-এর প্রতিষ্ঠাতা ফাদেল আবদুলঘানি জানাচ্ছেন, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি নিয়ে এ উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক। কিন্তু পাশাপাশি সব ধরনের বন্দিরা মুক্তি পেলে তা দুশ্চিন্তারও কারণ বইকি!
উল্লেখ্য, সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী জইশ আল-ইজ্জার যৌথবাহিনীর হামলায় পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। রাজধানী দামেস্কের পাশাপাশি একের পর এক শহর চলে গেছে বিদ্রোহীদের দখলে। দামেস্ককে ‘স্বাধীন’ বলে ঘোষণা করেছে ওই দেশের বিদ্রোহী গোষ্ঠী। কাতারের দোহায় সিরিয়ার দূতাবাসে শুরু হয়ে গেছে স্বাধীনতা উদযাপন। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ গাজি জালালিও জানিয়েছেন, তিনি ক্ষমতার হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুত। তবে তা হোক শান্তিপূর্ণভাবে।
গত ১৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়। সেখানে যুযুধান বেশ কয়েকটি পক্ষ। ২০১১ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে মদত দিতে শুরু করেছিল আমেরিকা। পরে আইএস-এর বাড়বাড়ন্ত রুখতে পূর্ব সিরিয়ার ডেইর আজ-জাওয়ার প্রদেশ এবং উত্তর-পূর্বের হাসাকা-সহ বিভিন্ন এলাকায় সেনা মোতায়েন করেছিল পেন্টাগন।
বিজ্ঞাপন