জনতা ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি: ৫৪ হাজার কোটি টাকা ৯ গ্রুপের দখলে

জনতা ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি: ৫৪ হাজার কোটি টাকা ৯ গ্রুপের দখলে

অনলাইন ডেস্ক, মোরনিউজবিডি
অনলাইন ডেস্ক, মোরনিউজবিডি

প্রকাশিত: ১২:০২ ২৩ জুলাই ২০২৫

দেশের অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক জনতা ব্যাংক এখন এক ভয়াবহ আর্থিক সংকটে। বিশ্লেষকদের ভাষায়, এটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি। প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে ব্যাংকটির। এর মধ্যে মাত্র ৯টি প্রভাবশালী গ্রুপের কাছেই আটকে আছে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলেছে।

সবচেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া প্রতিষ্ঠানটি বেক্সিমকো গ্রুপ, যাদের হাতে জনতা ব্যাংকের ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি আটকে আছে। এই গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো একটি গ্রুপকে এত বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার বিধান না থাকলেও, জনতা ব্যাংকের দিলকুশা শাখার ক্ষমতা বাড়িয়ে বেক্সিমকোকে এই ঋণ দেওয়া হয়। অধিকাংশ ঋণ পুনঃতফসিলের নামে স্থগিত থাকলেও আদায় হয়নি। উপরন্তু, রপ্তানির আড়ালে প্রায় ৪৫৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে এই গ্রুপের বিরুদ্ধে।

এই কেলেঙ্কারির সূত্রপাত ঘটে বিসমিল্লাহ গ্রুপের মাধ্যমে। জনতা ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকে তারা প্রায় ৬০০ কোটি টাকা জালিয়াতি করে আত্মসাৎ করে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলাও করে, চার্জশিট দেয়, কিন্তু অর্থ ফেরত আসেনি। সুদসহ বর্তমানে এই দায় ১,১০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। মূল আসামি খাজা সোলেমান চৌধুরী পরিবারসহ বিদেশে পলাতক।

ঋণখেলাপির তালিকায় আরও রয়েছে –

এস আলম গ্রুপ (১০,০০০+ কোটি টাকা), অ্যানন টেক্স গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, রানাকা গ্রুপ, গ্লোব জনকণ্ঠ, সিকদার গ্রুপ

এই গ্রুপগুলোর কাছে মোট ৫৩,৭৯০ কোটি টাকার ঋণ আটকে রয়েছে, যার বড় অংশই খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত।

বিশেষভাবে আলোচিত এস আলম গ্রুপ বর্তমানে জনতা ব্যাংকের অন্যতম বড় ঋণগ্রহীতা। তাদের মোট ঋণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ১,২০০ কোটি টাকা ইতোমধ্যেই খেলাপি। এছাড়া নাসা গ্রুপের ১২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংক নিজেদের বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করে, পরে আরও ঋণ দিয়ে দায় বাড়িয়ে ১,৫০০ কোটি টাকার বেশি করে।

এতবড় দুর্নীতি সত্ত্বেও, গত ১৫ বছরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে দুদকের উপ-পরিচালক মো. আল-আমিন এর নেতৃত্বে একটি বিশেষ তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে, যারা জনতা ব্যাংকের সকল ঋণ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র যাচাই করছে।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের অনিয়ম ও জালিয়াতি আসলে একটি ‘প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক ডাকাতি’, যার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও প্রশাসনিক দুর্বলতা।

দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “বারবার অভিযোগ, তদন্ত ও চার্জশিট দিয়েও অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এবার পরিস্থিতি বদলেছে। আমরা আশা করছি, নতুন তদন্ত দল স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হবে।”

এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। যথাসময়ে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসের মুখে পড়বে এবং জনগণের কষ্টার্জিত টাকায় প্রভাবশালীদের এই লুটপাট চলতেই থাকবে।

বিজ্ঞাপন