বাংলাদেশে পাকিস্তানের চোখ, চীনের ইঙ্গিতেই কি বরফ গলছে?

বাংলাদেশে পাকিস্তানের চোখ, চীনের ইঙ্গিতেই কি বরফ গলছে?

অনলাইন ডেস্ক, মোরনিউজবিডি
অনলাইন ডেস্ক, মোরনিউজবিডি

প্রকাশিত: ০৯:২০ ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে পাকিস্তান এখন অস্বাভাবিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক, কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক নানা কারণ। সম্প্রতি পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরকে অনেকেই নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে দেখছেন। ১৩ বছর পর পাকিস্তানের কোনো শীর্ষ কূটনীতিকের এই সফর বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে।

গত ২৩ আগস্ট ঢাকায় এসে ইসহাক দার তাঁর সফরকে “ঐতিহাসিক” আখ্যা দেন। তিনি করাচি থেকে চট্টগ্রাম কিংবা লাহোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত তরুণ প্রজন্মের যৌথ সহযোগিতার স্বপ্নের কথা বলেন। তাঁর মতে, এ সফর দুই দেশের সম্পর্কের বরফ গলাতে সহায়ক হবে এবং ভবিষ্যতের অংশীদারত্বে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পাকিস্তান মনে করছে, ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ের মতোই আবারও ঢাকা–ইসলামাবাদ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। নতুন সরকারের প্রতি পাকিস্তান ইতিবাচক ইঙ্গিতও পাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেনের মতে, পাকিস্তান বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, তা কৌশলগতভাবে কাজে লাগাতে চাইছে।

গত কয়েক মাসে দুই দেশের কূটনৈতিক ও সামরিক পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। বাংলাদেশের সেনা ও নৌবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা ইসলামাবাদ সফর করেছেন, অপরদিকে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রসচিব ঢাকায় এসেছেন। এভাবে ধাপে ধাপে দুই দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের সংলাপ বেড়েছে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর একটি। প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে দেশটি। অন্যদিকে পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। ২০২৪ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে ৬৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করলেও বাংলাদেশ মাত্র ৫৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, বাণিজ্য বাড়ানোর মাধ্যমে উভয় দেশ কাঁচামাল, বাজার ও বিনিয়োগে লাভবান হতে পারে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নের অন্যতম কারণ ভারত। দীর্ঘদিন ধরেই ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লি নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে। শেখ হাসিনা ভারতের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হওয়ায় পাকিস্তান নতুন সুযোগ দেখছে। সাবেক কূটনীতিক আইজাজ চৌধুরীর মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় ঢাকা-ইসলামাবাদ এক ধরনের কৌশলগত একমত পোষণ করছে।

চীন একইসঙ্গে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র। হাসিনা সরকারের সময়েও বেইজিং ঢাকায় শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিল। ক্ষমতার পরিবর্তনের পরও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের সম্ভাব্য জে-১০সি যুদ্ধবিমান ক্রয় এবং অবকাঠামো বিনিয়োগ এ প্রভাবেরই অংশ। ফলে চীনের ঘনিষ্ঠতার সূত্রে পাকিস্তান ও বাংলাদেশও একে অপরের কাছে আসছে।

তবুও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি দুই দেশের সম্পর্কে বড় বাধা হয়ে রয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা না চাওয়ায় বাংলাদেশে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব এখনো প্রবল। উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব সংকট ও সম্পদ বণ্টন–সংক্রান্ত দাবি এখনো অমীমাংসিত।

বিশ্লেষকদের মতে, ইতিহাসের ক্ষত থাকলেও ভবিষ্যত গড়ে ওঠে বর্তমান সহযোগিতা থেকে। অর্থনীতি, কূটনীতি ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্ক জোরদার করা সম্ভব। তবে মুক্তিযুদ্ধের দায় স্বীকার ও আস্থার সেতুবন্ধন তৈরি ছাড়া সম্পর্ক পুরোপুরি মজবুত হবে না।

সারকথা, পাকিস্তান রাজনৈতিক সুযোগ, অর্থনৈতিক প্রয়োজন ও কৌশলগত বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ঢাকা যদি বাস্তববাদী কূটনীতির মাধ্যমে এগোয়, তবে অতীতের ক্ষত সারিয়েও ভবিষ্যতের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব।

বিজ্ঞাপন