ক্ষোভের কারণ কি ৩২ নম্বরে বাসা হওয়াই? প্রশ্ন জলের গানের

ক্ষোভের কারণ কি ৩২ নম্বরে বাসা হওয়াই? প্রশ্ন জলের গানের

ছবি সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক, মোরনিউজবিডি
নিজস্ব প্রতিবেদক, মোরনিউজবিডি

প্রকাশিত: ১১:৩৭ ৭ আগস্ট ২০২৪

শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ। এর মধ্যে একদল অতি উৎসাহী জনতা শুরু করে ভাঙচুর-তাণ্ডবের মতো কাজ। গত সোমবার দুর্ভাগ্যজনকভাবে এক হামলার শিকার হয় জলের গানের দলনেতা ও ব্যান্ডের ভোকাল রাহুল আনন্দের বাসা।

এ বিষয়ে সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে জলের গান। সেখানে যুক্ত করা হয়েছে একটি গান। যে গানটি রাহুলের বাড়িতে রেকর্ড করা শেষ গান। বিবৃতিটি হুবহু তুলে ধরা হল-
‘স্বপ্নে তুমি দাগ দিও না, সরলরেখার স্বপ্নে কারও বাঁক দিওনা! বাঁক দিওনা!’
জলের গানের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি শুধু রাহুল আনন্দের বসত বাড়ি ছিলনা; ছিল পুরো দলটির স্বপ্নধাম, আনন্দপুর। যেখানে তৈরি হয়েছে কত গান, কত সু্র, আর দাদার (রাহুলের) ভাবনা প্রসূত শত শত বাদ্যযন্ত্র। শুধু তাই নয়। জলের গানের অফিশিয়াল স্টুডিও হিসেবেও ব্যবহৃত হত বাড়িটি। দলের সকলের দলগত সংগীত চর্চা থেকে শুরু করে, সকল স্টুডিও ওয়ার্ক-রেকর্ডিং, মিক্সিং, এডিটিং এখানেই হত। যারা নিয়মিত এই বাড়িতে যাতায়াত করতেন, তারা জানেন যে রাহুল আনন্দ ও উর্মিলা শুক্লার বাড়িটির সাদা গেটটি সবসময় খোলাই থাকত। তাতে তালা দেওয়া হতনা। যে কেউ, যেকোনো দরকারে যেন দাদার কাছে পৌঁছোতে পারে সেই ভাবনায়। আর যারাই দিনের যেকোন প্রান্তে এই বাড়িতে এসেছেন, সকলেই একটি চিত্রের সাথে খুব পরিচিত, তা হল- রাহুল আনন্দ মাটিতে বসে একটি সিরিশ কাগজ হাতে নিয়ে তার নতুন বাদ্যযন্ত্রের কাঠ ঘষছেন।


জলের গানের বাদ্যযন্ত্র। রাহুল আনন্দের বিরাট ভাবনা ও স্বপ্নের দিকে ধাবমান এক নিরন্তর প্রয়াস। আমাদের দেশীয় কাঠে তৈরি, আমাদের নিজেদের বাদ্যযন্ত্র। শুধুই কি আমাদের? এই দলের? জলের গানের? না! এই প্রয়াস সকল নবীন মিউজিশিয়ানদের জন্য, যারা বিশ্বাস করবে - আমরাও আমাদের বাপ দাদার মতো নিজেদের বাদ্যযন্ত্র নিজেরাই তৈরি করে নিতে পারি! এই প্রয়াস সেই স্বকীয়তার; যার বলে এই দেশের মানুষ গর্বের সাথে বলতে পারে, এই আমাদের নিজেদের বাদ্যযন্ত্রে বেজে ওঠা অনন্য শব্দতরঙ্গ যা কিনা পুরো পৃথিবীর বুকে কেবল এই বাংলাদেশের মাটিতেই ঝনঝন করে বাজে, সুর তোলে, স্বপ্ন দেখায়। যেই স্বপ্নের ঝিলিক সুদূর ফ্রান্স থেকে আরেকজন মিউজিশিয়ানকে আমাদের দেশে টেনে আনে। পুরো পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষের চোখের আলো পড়ে আমাদের এই দেশে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের এই বাড়িটিতে। তবে কি এই ঠিকানায় আবাস হওয়াটাই কিছু মানুষের এত ক্ষোভের কারণ? এত রাগের বহিঃপ্রকাশ? যারা ইতোমধ্যে সেখানে গিয়েছেন কিংবা ফেসবুকে পোস্ট দেখেছেন তারা সকলেই খবরটি জানেন।
হ্যাঁ!-রাহুল আনন্দ ও উর্মিলা শুক্লার, এবং আমাদের সকলের প্রিয় জলের গানের এই বাড়িটি আর নেই। সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং আশীর্বাদে বাড়ির সকল সদস্য নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন এবং এখন নিরাপদে আছেন। কিন্তু, রাহুল দা এবং আমাদের দলের সকল বাদ্যযন্ত্র ,গানের নথিপত্র এবং অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ছাড়াও, দাদার পরিবারের খাট-পালং, আলনা আর যাবতীয় সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! সব! সকলের জন্য নিরন্তর ভেবে যাওয়া মানুষটিকে পরিবারসহ এক কাপড়ে তার নিজ ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এর প্রভাব হয়ত আজীবন লালিত থাকবে তার সন্তানের মনে; যার বয়স কিনা মাত্র ১৩ বছর- ভাবতেই কষ্ট হয়। এতদিন ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন সংসারের সবকিছু দাউদাউ করে জ্বলেছে চোখের সামনে। কিছু মানুষের ক্রোধ এবং প্রতিহিংসার আগুনে!
এই বাদ্যযন্ত্র, গান বা সাজানো সংসার হয়ত আমরা দীর্ঘ সময় নিয়ে আবার গড়ে নিতে পারব। কিন্তু, এই ক্রোধ আর প্রতিহিংসার আগুনকে নেভাব কীভাবে! কেন আমরা ভালবাসা আর প্রেম দিয়ে সবকিছু জয় করে নিতে পারি না? যেই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি, সেই স্বাধীনতার রক্ষায় যদি একইভাবে এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হই, তাহলে চরম নিরাশা, অপমান ও লজ্জায় নিজেদের গানই গেয়ে উঠি এক ভগ্ন হৃদয়ে-


    "কোন ছোবলে স্বপ্ন আমার হলো সাদা কালো? 
     আমার বসত অন্ধকারে; তোরা থাকিস ভালো!"

সকল প্রাণ ভাল থাকুক। নতুন আগামীর স্বপ্নকে আমরাও অভিবাদন জানাই একইভাবে। কিন্তু, নিজের উল্লাসের চিৎকার এবং সজোর হাততালিতে কারো স্বপ্ন ভেঙে না দেই!
এই গানটি আমাদের এই ঘরে রেকর্ড করা শেষ গান। ভিডিওতে যা দেখছেন, তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। উত্তাল সময়ের সাথে আমরাও একাত্ম ছিলাম গানে গানে। এই শেষ কাজটিই তবে সকলের জন্য আনন্দ উপহার। জয়তু জলের গান।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সব সময় সক্রিয় দেখা গেছে রাহুল ও তার দলকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংহতি জানিয়েও নিজের দলের সদস্যদের নিয়ে রাজধানীর রবীন্দ্র সরোবরে সংগীতশিল্পীদের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। এরপরও তছনছ করা হয়েছে তার বাড়ি।
রাহুলের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে তার অনুরাগীদের আগ্রহ ছিল আকাশছোঁয়া। তাদের অনেকেই হয়ত ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন একটিবারের মত রাহুলের বাদ্যযন্ত্রগুলো দেখে আসার। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রোও গেছেন তার বাড়িতে! কিন্তু সে স্বপ্ন হয়ত আর কখনই পূরণ হবে না রাহুলের অনুরাগীদের; কারণ একদল দুর্বৃত্তের হামলায় নিমিষেই শেষ হয়ে যায় রাহুলের দীর্ঘদিনের পরিশ্রম।

বিজ্ঞাপন