বুধবার , ২৫ জুন, ২০২৫ | ১১ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ০৭:০১ ২৪ জুন ২০২৫
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক লক্ষ্যভিত্তিক হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অন্তত ১৪ জন শীর্ষ বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। এই ঘটনাকে বিশ্লেষকরা নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, এটি কেবল হামলাই নয়, বরং ইরানের পরমাণু সক্ষমতার পেছনের প্রধান মস্তিষ্কদের পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে দেওয়ার এক বিস্ময়কর কৌশল। তবে তারা মনে করেন, এতে কর্মসূচিতে কিছুটা বিলম্ব ঘটলেও ইরানের পরমাণু জ্ঞান বা সক্ষমতা পুরোপুরি থেমে যাবে না।
ইসরায়েলের ফ্রান্সে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত যোশুয়া জারকা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এই বিজ্ঞানীদের মৃত্যুর ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি “একাধিক বছর পিছিয়ে গেছে।” তার ভাষায়, “এই পুরো দলটি এখন আর নেই, এটি কার্যত কয়েক বছরের পিছিয়ে দেওয়া।”
কে ছিলেন নিহত এই বিজ্ঞানীরা? রাষ্ট্রদূত জারকা জানান, নিহতদের মধ্যে ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী, কেমিস্ট ও পরমাণু প্রকৌশলীরা। ১৩ জুনের প্রথম দফা হামলায় নয়জন নিহত হন। এদের অনেকেই বিস্ফোরক তৈরি, পারমাণবিক উপকরণ বিশ্লেষণ এবং অস্ত্র নির্মাণে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ইরানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের বরাতে জানা যায়, মোহাম্মদ রেজা সেদিঘি সাবের নামের এক বিজ্ঞানীও নিহত হয়েছেন, যিনি আগের এক হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও তার ১৭ বছর বয়সী ছেলে নিহত হন।
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে উদ্দেশ্য কী ছিল? বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের মতো দেশে বিকল্প বিজ্ঞানীর অভাব নেই। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মার্ক ফিটজপ্যাট্রিক বলেন, “পরিকল্পনা বা ব্লুপ্রিন্ট থেকে যাবে, এবং নতুন প্রজন্ম ঠিকই সেই কাজ চালিয়ে নিতে পারবে।” তবে এই হামলা নতুন বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেও হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জেনেভাভিত্তিক বিশ্লেষক পাভেল পোদভিগ বলেন, “সম্ভবত এটাই লক্ষ্য ছিল—যাতে ভবিষ্যতের কেউ এই কর্মসূচিতে যোগ দিতে ভয় পায়।”
এই ঘটনার পর নতুন করে আন্তর্জাতিক আইনি ও কূটনৈতিক বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে, বেসামরিক নাগরিক ও অসামরিক ব্যক্তিদের হত্যায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে কেউ যদি সরাসরি সামরিক কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে সে আইন প্রযোজ্য নাও হতে পারে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন আর. ডেভিড মনে করেন, “এই বিজ্ঞানীরা এমন একটি রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করছিলেন, যারা নিয়মিত ইসরায়েল ধ্বংসের হুমকি দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে তারা বৈধ লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন।” তবে এমোরি ল স্কুলের অধ্যাপক লরি ব্ল্যাঙ্ক বলেন, “আমরা বাইরে থেকে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না এই হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় পড়ে কি না।”
ইরানের বিজ্ঞানীদের হত্যার ইতিহাস নতুন নয়। ২০২০ সালে মোহসেন ফখরিজাদে নামে ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীকে রিমোট-কন্ট্রোল মেশিনগান দিয়ে হত্যা করা হয়, যার জন্য তেহরান সরাসরি ইসরায়েলকে দায়ী করেছিল। তবে এবারই প্রথম ইসরায়েল সরাসরি এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করল। রাষ্ট্রদূত জারকা বলেন, “যদি এসব অপারেশন না চলত, তাহলে ইরান অনেক আগেই পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলত।”
সবশেষে বিশ্লেষকদের অভিমত, এই হত্যাকাণ্ড ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামাতে পারবে না, কেবল সাময়িকভাবে বিলম্বিত করতে পারে। বরং এতে নতুন করে আইন, কূটনীতি এবং মানবিক মূল্যবোধের আলোকে আলোচনা শুরু হয়েছে। ইরান যেমন প্রকাশ্যে যুদ্ধঘোষণা করেনি, তেমনি ইসরায়েলও একটি শক্তিশালী বার্তা দিল—পারমাণবিক হুমকির মুখে আর কেউ নিরাপদ নয়।
বিজ্ঞাপন