শনিবার , ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৭ পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ০৯:০৪ ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
স্বাধীনতাত্তোর প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডীন অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ। ২৪ সেপ্টেম্বর নবনিযুক্ত উপাচার্য কাজে যোগদান করেছেন। গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে উপাচার্যের নিকট রয়েছে শিক্ষার্থীদের আকাশসম প্রত্যাশা। শিক্ষার্থীদের সেইসব প্রত্যাশা তুলে ধরছেন আমাদের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি তানিম তানভীর।
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক অবকাঠামো গঠন
মোসাদ্দেক হোসেন-আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ
বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে একটি ছোট দেশ হলেও কিছু জায়গায় এ ছোট দেশটি সর্বদা প্রথম সারিতে ছিল এবং রয়েছে । সেটা হল দুর্নীতি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশের সর্বত্র দুর্নীতির মহোৎসব পালন করা হয়। এদিক থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কোনো অংশে পিছিয়ে ছিল না। ভিসি থেকে শুরু করে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই যেন এক মারাত্মক আনন্দে এ খেলায় মেতে থাকে। সপ্তাহে সাত দিনের তিনদিন দুর্নীতির অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দের অর্ধেক যায় প্রশাসন নামক রাঘব বোয়ালদের পকেটে। শিক্ষার্থীদের হাজার সমস্যা থাকলেও তারা থাকে তাদের ভবিষ্যৎ গোছানোর চিন্তায়। আমরা যেন গড়িয়ে গড়িয়ে অধঃপতনের প্রায় নিম্নতম অবস্থানে চলে এসেছি। অসহায় আর্তনাদ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাই নতুন ভিসির নিকট আমার প্রত্যাশা পূর্বের ভিসির অডিও ফাঁসে দুর্নীতির যে ঘ্রাণ পাই তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থকে সর্বদা অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের দেয়া বরাদ্দের একটি পয়সাও যেনো অপব্যবহার এর খাদে না যায়। মনে রাখা উচিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের প্রভু নয়, তারা শিক্ষার্থীদের সেবক। প্রশাসনে যুক্ত থাকা সকলকে জবাবদিহির আওতায় থাকতে হবে। সর্বোপরি সকলের মানসিকতা যে দুর্নীতিতে সয়লাব , তার থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে যোগ্য প্রশাসক হিসেবে প্রমাণ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চমানে নিয়ে যাওয়া সময়ের প্রত্যাশা।
সেশনজট নিরসন
ইকবাল হোসেন ইমন-আল হাদিস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পিছনে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো সেশনজট। সেশনজটের করালগ্রাসে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ালেখা ও গবেষণার স্পৃহা হারিয়ে ফেলে শিক্ষার্থীরা। এই সেশনজটের প্রধান কারণ বিভাগে দায়িত্বরত শিক্ষকদের দায়িত্বহীন আচরণ। শিক্ষকরা নিজ ক্লাস বাতিল করে রাজনৈতিক মিটিং মিছিল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। শিক্ষকদের মধ্যে সাদা, লাল ও নীল দল নিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে ক্রোন্দল সৃষ্টি হয়। যার ফলে পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফলাফলে বিলম্ব হয়। ফল হিসেবে ৪ বছরের কোর্স ৬ বছর লাগে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব আছে। নতুন ভিসি মহোদয়ের সমীপে প্রতিটি বিভাগে পর্যাপ্ত মনিটরিং এর মাধ্যমে সেশনজট নিরসনের প্রত্যাশা করি।
লেজুরভিত্তিক ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ
লুবাবা ঐশী-‘ল এন্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
গণঅভ্যুত্থানে ঐতিহাসিক ‘নয় দফা’ দাবির অন্যতম একটা দাবি ছিল সকল ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা। নতুন ভিসির কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ করবেন। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির ফলে রাজনৈতিক দল হলগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করে। ফলে ক্যাম্পাসে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা ও সমস্যা সৃষ্টি হয়। দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি পরিবর্তে সুস্থ ধারার ছাত্র সংসদ ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি চালু রাখা যেতে পারে।মূলত আমাদের সিস্টেমটা বদলানো উচিত। একজন শিক্ষকের যখন উপরে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা রাজনীতি, সেক্ষেত্রে সবসময় তারা রাজনীতি নিয়ে পরে থাকে।।রাজনীতির ফলে শিক্ষকরা ক্লাস পরীক্ষা বাদে রাজনীতির মিটিং মিছিলে দৌড়াদৌড়ি করে। শিক্ষকের কাজ হলো গবেষণা করা ও জাতি গঠন করা। তাছাড়া ফ্যাসিবাদী আমলেও লক্ষ্য করেছি অনেক অযোগ্য লোক দলীয়ভাবে বড় অংকের টাকা দিয়ে নিয়োগ পেয়েছে। সিস্টেম হওয়া দরকার এমন যে, শিক্ষকের মূল্যায়ন পদ্ধতি হবে মেধার ভিত্তিতে, কার গবেষণা প্রবন্ধ বেশি। এছাড়া ছাত্রদের কাছে কার গ্রহণযোগ্যতা বেশি এর ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া উচিত।
সফিকুল ইসলাম
আইন বিভাগ-অযৌক্তিক লাগামহীন ছুটি হ্রাসকরণ
প্রায় প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা যেখানে সেশনজটের অভিশাপে হতাশায় নিমজ্জিত, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চলতি বছরে (সাপ্তাহিক ছুটিসহ) সকল ছুটি মিলিয়ে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৭৩ দিন ছুটি রেখেছে। এই লাগামহীন ছুটির কারণে ক্লাস-পরীক্ষা সময় মত শেষ করা সম্ভব হয় না । ফলে সেশনজট বেড়েই চলেছে। ইবিতে ছুটির অবস্থা এমন যে, অনেকেই উপহাস করে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে গর্ভবতী বিশ্ববিদ্যালয় বলে থাকেন। এমন নাজুক পরিস্থিতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে দ্রুত উত্তরণের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা করছি।
বিশ্বমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরিতে গবেষণায় গুরুত্ব
আহমদ আব্দুলাহ-রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ সমৃদ্ধ করা, গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ এবং আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রকল্প চালু করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
গবেষণা ও প্রজেক্টের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। এতে ছাত্র-শিক্ষক মেলবন্ধন আরও মজবুত হবে। তিনি শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করতে পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী করা, শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মশালা এবং সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষার প্রসারে জোর দিবেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ও অনলাইন শিক্ষার প্রসার ঘটানোর সাথে সাথে আন্তর্জাতিক বৃত্তি, এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম এবং গবেষণা সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করতে ভিসির জোর দেওয়া উচিত।
আবাসন ও খাবারের মান বৃদ্ধিকরণ
উমাইয়া উর্মী-ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
আমাদের সবচেয়ে বড় সংকট আবাসন সমস্যা। আমরা অধিকাংশ শিক্ষার্থী পুরো ক্যাম্পাস জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি তবুও হলে একটা সিট বরাদ্দ পাচ্ছি না। আর দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে খাবারের নিম্নমান । বৈধভাবে হলের সিট বরাদ্দ ও আসন সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে আবাসন সমস্যা নিরসন, হলের ডাইনিংগুলোতে খাবারের মান বৃদ্ধিকরণ ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা খুবই জরুরি। এছাড়া, বিশেষ করে হলের রিডিংরুম গুলো সংস্কার এবং আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করে যুগোপযোগী ও আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা। হলগুলোতে গেস্টরুম এবং গণরুমের অমানবিক জীবনধারণের যে রীতি চলে আসছে তার অবসান করে নতুন ভিসি শিক্ষার্থীদের এই কাঙ্ক্ষিত সুবিধাগুলো নিশ্চিত করে সুষ্ঠু সুন্দর এবং পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবেন বলে প্রত্যাশা করি।
সেবাখাতের আধুনিকায়ন
আবু উবায়দা-ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি
শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। ক্লাসের বাইরে পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সংস্কারের আওতায় আনা উচিত। সার্বক্ষণিক লাইব্রেরি খোলা রাখা ও বিভাগীয় সকল বইসহ জ্ঞানমূলক বই-এর সংগ্রহ সমৃদ্ধ করা উচিত। এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জরুরি সেবা খাতের দিকে নতুন প্রশাসনের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ইতোপূর্বে আমরা অনেকেই লক্ষ্য করেছি দায়িত্বরত চিকিৎসক মাঝেমধ্যে অনুপস্থিত থাকেন বা কাজে দেরিতে আসেন। আবার চিকিৎসা প্রদানে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় গুরুতর আহত রোগীদের চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হন তারা। সকল ধরনের চিকিৎসা আমরা ক্যাম্পাসের মধ্যেই যেন পাই। এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি সেবা খাতকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে সকল প্রকার হয়রানি থেকে ছাত্রদের মুক্তি দিতে হবে।
বিজ্ঞাপন