তেঁতুলিয়ায় বোমা মেশিনে চলছে অবাধ পাথর উত্তোলন: প্রশাসনের চোখের সামনেই প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাট!

তেঁতুলিয়ায় বোমা মেশিনে চলছে অবাধ পাথর উত্তোলন: প্রশাসনের চোখের সামনেই প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাট!

জেলা প্রতিনিধি, পঞ্চগড়
জেলা প্রতিনিধি, পঞ্চগড়

প্রকাশিত: ০৬:৫৯ ১৭ মে ২০২৫

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় চলছে ভয়াবহ পরিবেশ ধ্বংসের মহোৎসব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ জনপদে রাতের অন্ধকারে বোমা মেশিন (ড্রেজার) দিয়ে অবাধে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রশাসন, পুলিশ ও বিজিবির একাধিক অভিযান চালানো সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি এই অবৈধ কার্যক্রম।

বোমা মেশিন বা ড্রেজার হলো এক ধরনের শক্তিশালী খননযন্ত্র, যা মাটির গভীরে পানি ও বালু টেনে তুলে পাথর উত্তোলন করে। এই যন্ত্র ব্যবহারে জমির অভ্যন্তরে গভীর গর্ত বা শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যার ফলে মাটি ধসে পড়ার আশঙ্কা বাড়ে। ভূগর্ভস্থ পানি স্তর নেমে যাওয়ার পাশাপাশি তৈরি হয় ভূমিকম্পের ঝুঁকি। পরিবেশবিদদের মতে, এভাবে খনিজ উত্তোলন চলতে থাকলে একসময় পঞ্চগড়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস হয়ে যাবে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন ইউনিয়নের অন্তত ২০টির বেশি গ্রামে ৫০টির বেশি বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন চলছে। দেবনগড় ইউনিয়নের ময়নাগুড়ি, পাঠানপাড়া, কায়লামনি, শিবচন্ডি; ভজনপুর ইউনিয়নের গনাগছ, কির্তনপাড়া, ভাঙ্গিপাড়া, খুনিয়াগছ; বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ডাহুক নদীর তীরবর্তী এলাকা; শালবাহান ইউনিয়নের সানু বালাবাড়ি এবং সদর ইউনিয়নের বড়বিল্লাহ, মাঝিপাড়া প্রভৃতি এলাকায় এসব যন্ত্র বসানো হয়েছে।

এই যন্ত্রগুলো শুধু নদী বা খাসজমিতেই নয়, বসানো হয়েছে ফসলি জমি, মাছের ঘের, এমনকি বন বিভাগের জমিতেও। প্রতিটি স্থানে উত্তোলনকারীদের লোক পাহারায় থাকে। প্রশাসনের গাড়ি বা টহল দলের উপস্থিতি টের পেলেই তারা মালিকদের আগেই সতর্ক করে যন্ত্র বন্ধ করে দেয়।

এলাকাবাসী বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই প্রশাসনের কাছে এসব অবৈধ যন্ত্র ও ব্যবসায়ীদের নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ‘ভূমি অধিকার রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে ইতোমধ্যে মানববন্ধনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাধারণ কৃষকরা জমির ধস, পানি সংকট ও ফসলি জমি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।

সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও পাথর শ্রমিক নেতা মুক্তারুল হক মুকু জানান, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় এই বোমা মেশিনগুলো অবাধে চলছে। তিনি বলেন, “রাতের আঁধারে দলীয় নেতাদের ছায়াতলে প্রকাশ্যেই চলছে এসব যন্ত্র। প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।”

অজ্ঞাত পরিচয়ে একাধিক বোমা মেশিন মালিক জানান, প্রতিদিন রাতে একটি মেশিন চালাতে জনপ্রতিনিধি, পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করতে হয়। প্রতিটি মেশিনের জন্য প্রায় ৪ হাজার টাকা করে দিতে হয় দালালের মাধ্যমে।

তেঁতুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুসা মিয়া বলেন, প্রতিরাতে পুলিশ টহল দেয়, কিন্তু আগেভাগে খবর পেয়ে চক্রটি মেশিন বন্ধ করে পালিয়ে যায়। একাধিক মামলা হলেও আসামিরা জামিন পেয়ে আবারও একই কাজ শুরু করে।

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফরোজ শাহীন খসরু বলেন, আমরা গণসচেতনতা তৈরিতে কাজ করছি। অনেক মেশিন জব্দ করে মামলা করা হয়েছে। কিন্তু সমাজের সব মহলের সহযোগিতা না পাওয়ায় কার্যকর প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে না।

জেলা প্রশাসক সাবেত আলী বলেন, অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে একাধিকবার সভা করে সতর্ক করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মনিরুল ইসলাম জানান, ড্রেজার মেশিন বন্ধে বিজিবি ইতোমধ্যে কাজ করেছে। প্রয়োজনে আরও বড় পরিসরে অভিযান চালানো হবে।

জেলা পরিবেশ পরিষদের সভাপতি এবং ভূগোল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তৌহিদুল বারী বলেন, এইভাবে চলতে থাকলে অচিরেই পঞ্চগড়ের মানুষকে চরম মূল্য দিতে হবে। পাথর উত্তোলনের নামে প্রকৃতি ধ্বংসের এই খেলায় সকলকে রুখে দাঁড়াতে হবে বলে তিনি আহ্বান জানান।

খাদেমুল ইসলাম/এম এন পি 

বিজ্ঞাপন