রবিবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৭ পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ০৬:৩৬ ২০ আগস্ট ২০২৪
কিশোরগঞ্জে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদের জমির সন্ধান মিলছে। তার নিজের ভাই, স্ত্রী-সন্তান, স্বজনদের নামে ও বেনামে কেনা হয়েছে জমি, ফ্ল্যাট ও রিসোর্ট।
কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের হোসেনপুর গ্রামের পাশের হাওরে হারুনের প্রায় তিন হাজার শতক (৩০ একর) জায়গাজুড়ে একটি পুকুরের চারপাশে প্রায় ১ শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত অত্যাধুনিক ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’ দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর চালু হওয়া রিসোর্টির এক পাশে ২০টি দোতলা কটেজে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ৪০টি কক্ষ (স্যুট), আছে রেস্টুরেন্ট, পার্টি সেন্টার, শিশুদের গেম জোন ও ওয়াচ টাওয়ার। একেকটি স্যুটের দৈনিক ভাড়া ছয় হাজার থেকে ২৮ হাজার টাকা।
জানা যায়, এই রিসোর্টটি ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয়েছিল। রিসোর্ট এলাকার মাঝে রয়েছে বিশাল আয়তনের একটি দীঘি। এর মাঝখানে হেলিপ্যাড। বিগত সরকারের একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী, সচিব এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও উদ্বোধনকালে সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতিপুত্র রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক ও চিত্র নায়ক-নায়িকা ও হারুনসহ দেশের গণমান্য ব্যক্তিবর্গ অংশ নেন। বিশাল এ স্থাপনার মালিক সদ্য সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ। রিসোর্টটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার ছোট ভাই ডা. শাহরিয়ার।
রিসোর্টের বাইরে হারুন কৃষকদের তিন-চারশ একর জমি তার অ্যাগ্রো ফার্মের জন্য দখলের পায়তারা করেছেন বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, শতাধিক একর জমি বাঁধ দিয়ে গত বছর দখল করে নিয়েছেন তিনি। গত শুকনা মৌসুমে হারুনের ছোট ভাই শাহরিয়ারের নেতৃত্বে মিঠামইনের হোসেনপুর থেকে অষ্টগ্রামের ভাতশালা পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকায় মাটির বাঁধ নির্মাণ করেছেন।
কৃষকদের জমি কেটে নির্মীয়মাণ বাঁধে মাটি ফেলা হচ্ছে। তবে বর্ষা এসে যাওয়ায় বাঁধটি সম্পূর্ণ হয়নি।
মিঠামইনের একটি গ্রামের নৌকাচালক বলেন, ঐ যে বড় বড় বিল্ডিং দেখছেন এই সবকিছু হারুন সাহেবের। এইগুলো দেখতে কিছুদিন পর পর নায়ক-নায়িকা, মন্ত্রী, এমপি নিয়ে ঘুরতে আসেন। উনি বাংলাদেশের অনেক বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন। এছাড়া রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অনেক মিল আছে। যার জন্য উনারে খুশি রাহার (রাখার) লাইগা নাম রাখছে পেসিডেন রিসুট।
মিঠামইন সদরের কামালপুর গ্রামে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাড়ি।
রিসোর্ট এলাকার মাঝে রয়েছে বিশাল আয়তনের একটি দীঘি। এর মাঝখানে হেলিপ্যাড। বিগত সরকারের একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী, সচিব এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও রিসোর্টে বেড়াতে এসেছেন। বিশাল এসব স্থাপনার মালিক সদ্য সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ।
সরজমিনে, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের এলাকায় গিয়ে ভুক্তভোগী এবং নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে তার বিপুল সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। স্থানীয় লোকজনের প্রশ্ন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা এত অর্থবিত্তের মালিক হন কিভাবে? তার বিপুল সম্পদের কথা লোকমুখে আলোচিত হলেও হয়রানির ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ প্রশাসন তাকে ডিবিপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হারুনের বিপুল সম্পদের উৎস সম্পর্কে খোঁজখবর নেয় অনেকেই। মিঠামইন সদর ও হোসেনপুর গ্রামের ভুক্তভোগী মানুষের সঙ্গে কথা বললেও কেউ নাম-ঠিকানা প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এছাড়া তার পরিবারের সদস্যদের নামে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের নীলগঞ্জ রোড, উকিলপাড়া এলাকায় তিনতলা বিশিষ্ট বিশাল ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে।
উকিলপাড়াস্থ ফ্ল্যাটটি ৭ বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিল তবে সেখানে হারুন বা তার কোনো আত্মীয়-স্বজন বসবাস করে না, ফ্ল্যাটটিতে ভাড়াটিয়া বসবাস করতো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করার পর ভাড়াটিয়ারা বাসা ত্যাগ করে চলে যান। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় বাসাটি তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।
হারুন অর রশীদ কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার হোসেনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মৃত আবদুল হাসিম ও মা জহুরা খাতুন। বাবা পেশায় কৃষক ছিলেন।
পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে হারুন এলাকার লোকজনের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নেন। ১৯৯৩-৯৪ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে সালসাবিল বাসের টিকিট চেকারের চাকরি নিয়েছিলেন। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সহযোগিতায় হারুন তার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বানিয়েছিলেন। সেটি ব্যবহার করেই বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশের চাকরি পান তিনি। সারদায় ট্রেনিংয়ের সময় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে চাকরিচ্যুত হন তার। এরপর মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি করেন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগ করার কারণে হারুন পুলিশের চাকরি ফিরে পান তিনি।
হারুনের ভাই ডাক্তার শাহরিয়ার মিঠামইনে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। আরেক ভাই মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান (জিয়া) পুলিশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে এএসআই পদে চাকরি করছেন।
সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার ভাই, প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট ও অ্যাগ্রো ফার্মের পরিচালক ডা. এবি এম শাহরিয়ারের ফোনও বন্ধ রয়েছে।
বিজ্ঞাপন