বৃহস্পতিবার , ৩১ জুলাই, ২০২৫ | ১৬ শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ০৭:২৭ ৩০ জুলাই ২০২৫
বিশ্ব রাজনীতিতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি একটি দীর্ঘদিনের বিতর্কিত ও আলোচিত ইস্যু। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে—ইরান নাকি গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চায়। কিন্তু এই দাবির পক্ষে এখনো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) বা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেনি।
ইরান সব সময় দাবি করে এসেছে—তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ এবং বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত। প্রশ্ন হলো, যদি ইরান চায়, তাহলে এত বছরে বোমা বানায়নি কেন? এবং না চাইলেও, কেন এত উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে ইরানের ধর্মীয় মূল্যবোধ, কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতকে একসঙ্গে বিশ্লেষণ করতে হবে।
২০০৩ সালে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একটি ফতোয়া জারি করেন, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়—পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি, মজুত কিংবা ব্যবহার ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ‘হারাম’। এটি শুধু একটি ধর্মীয় ফতোয়া নয়, বরং একটি নৈতিক ঘোষণা, যেখানে বলা হয়েছে—পারমাণবিক অস্ত্র নিরীহ মানুষের ওপর গণহত্যা চালায়, যা ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে।
ইরানের দৃষ্টিতে হিরোশিমা ও নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞ এই নিষেধাজ্ঞার বাস্তব উদাহরণ। তারা মনে করে, পারমাণবিক অস্ত্র মানবতা, পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। ইসলামের যুদ্ধনীতিতে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা নিষিদ্ধ এবং সেই নীতিকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে ইরান।
অনেকে মনে করেন, পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে একটি দেশ নিরাপদ থাকে। কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। যেমন:
এই বাস্তবতা ইরানকে বুঝিয়েছে—শুধু পারমাণবিক অস্ত্র নয়, কার্যকর প্রতিরোধব্যবস্থা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নিরাপত্তার চাবিকাঠি। তাই ইরান বেছে নিয়েছে উন্নত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং আধুনিক প্রতিরক্ষামূলক প্রযুক্তির পথে অগ্রসর হওয়ার নীতি।
পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার মতো ইউরেনিয়াম মজুত থাকলেও ইরান কেন সে পথে যায় না? কারণ, এই পথে গেলে তাদের সামনে তিনটি বড় রাজনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে:
ইরান ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে। ২০০৫ সালের পর থেকে দেশটির বিরুদ্ধে দেড় হাজারেরও বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নতুন করে পারমাণবিক বোমা বানালে এই নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর হবে এবং জনজীবনে গভীর প্রভাব ফেলবে।
চীন ও রাশিয়ার মতো শক্তিশালী মিত্ররা এনপিটির (NPT) সদস্য। তারা কোনোভাবেই চায় না, ইরান নতুন করে পারমাণবিক শক্তিধর হোক। ফলে এমন পদক্ষেপে ইরান আন্তর্জাতিক সমর্থন হারিয়ে ফেলবে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ চালিয়েছে (১৩ ও ২২ জুন)। ভবিষ্যতে যদি ইরান সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের ঘোষণা দেয়, তাহলে দুই দেশ একসঙ্গে বড় আকারে সামরিক অভিযানে যেতে পারে।
ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে, যদিও অস্ত্র-মানের ইউরেনিয়ামের জন্য ৯০ শতাংশ প্রয়োজন। বিশ্লেষকদের মতে, এটা একটি কৌশলগত চাপে রাখার পন্থা। এর মাধ্যমে তারা:
ইরান ১৯৬৮ সালের এনপিটির সদস্য এবং ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত জেসিপিওএ-চুক্তির অধীনে তাদের কর্মসূচি সীমিত রেখেছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফাভাবে সেই চুক্তি বাতিল করেন। এরপর থেকেই ইরান তার অবস্থানে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়।
সম্প্রতি আইএইএ ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পর ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান আইএইএর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রোসির সফর প্রত্যাখ্যান করে।
বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি একে যথার্থভাবেই বলেছেন—“যে অস্ত্র ইসরায়েলের হাতে নিরাপত্তা, সেটি ইরানের হাতে হুমকি—এটাই বিশ্বরাজনীতির ভণ্ডামি।”
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে ইরানকেই পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছিল। আজ সেই ইরানকেই হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করছে। অন্যদিকে, ইসরায়েল কখনোই এনপিটিতে স্বাক্ষর করেনি এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রায় ৮০–৪০০টি পারমাণবিক বোমা থাকার সম্ভাবনা থাকলেও তাদের কোনো জবাবদিহি নেই।
ইরান জানে, পারমাণবিক অস্ত্র কৌশলগতভাবে আত্মঘাতী এবং নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। তাই তারা বেছে নিয়েছে নীতিনির্ভর কূটনৈতিক পথ। শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের অধিকার তাদের রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত তা সম্মান করা।
চাপ নয়, সংলাপই পারে উত্তেজনাকে প্রশমিত করতে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি যদি ন্যায় ও অংশগ্রহণভিত্তিক হয়, তাহলে শুধু ইরানের জন্যই নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি নিরাপদ ও ভারসাম্যপূর্ণ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব।
বিজ্ঞাপন